ঢাকা শহর নিয়ে প্রসূন রহমানের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র
উপমহাদেশের নারীদের জীবনের গল্প নিয়ে ‘সুতপার ঠিকানা’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের সহকারী প্রসূন রহমান। ছবিটি দেশে-বিদেশে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এই নির্মাতা এবার হাতে নিয়েছেন তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের কাজ। তার নতুন ছবির নাম ‘ঢাকা ড্রিম’।
মূলত ঢাকা শহর নিয়ে ধারবাহিকভাবে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন প্রসূন রহমান। সেই ঢাকা ট্রিলজির প্রথমটি হবে ঢাকা ড্রিম।
প্রসূন জানান, ঢাকা শহরকে নিয়ে তার নতুন ছবির গল্প। বিশ্বের আলোচিত-সমালোচিত এই শহরের মানুষ, রাজপথ, দৈনন্দিন সমস্যা ও প্রতিকারের ভাবনা, স্বপ্ন এবং স্বপ্ন ভঙের চিত্র থাকবে ঢাকা ট্রিলজিতে। তিনটি আলাদা গল্প দিয়ে ঢাকা ছবি তৈরি করেবন তিনি।
তিনি ছবিটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিনিয়ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ঢাকায়। আর্ন্তজাতিক নানা প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী বসবাসযোগ্যতার মানের দিক থেকে এ শহরের অবস্থান সবচেয়ে নীচে। কিন্তু এরপরেও এ শহরে মানুষ আসা থামছেনা। থামানো যাচ্ছেনা। হয়তো জীবিকার প্রয়োজনে এদেশের মানুষের কাছে ঢাকায় আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।’
প্রসূন আরো বলেন, ‘এখানে কেউ যেমন আসছে জীবিকার প্রয়োজনে, কেউ আসছে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে, কেউ আসছে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে। যারা আসছে তাদের কেউই আর ফিরে যাচ্ছেনা, ফিরে যেতে পারছেনা। রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, এমনকি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সবকিছুরই কেন্দ্রস্থল এইখানে। সবকিছুর ভারেই পদানত এই নগরী। এই স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের শহর নিয়ে ধারাবাহিক ৩টি চলচ্চিত্রের আয়োজনে সময়কে ধরবার চেষ্টা করা হবে ‘ঢাকা ট্রিলজি’তে।’
ট্রিলজি’র প্রথম পর্ব ঢাকা ড্রিমের গল্প হিসবে নির্মাতা বেছে নিয়েছেন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকা শহরে মানুষের আসবার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প। ঢাকা ড্রিম ছোটো একটি জেলা শহর থেকে জীবিকার প্রয়োজনে এবং নানামুখী স্বপ্নপূরণে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো কিছু মানুষের গল্প। প্রথমবারের মতো ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করা কিছু মানুষের ঢাকায় আসবার পেছনের কারণ ও যাত্রার দিনের অন্যরকম এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতার গল্প। যা একই সাথে পৃথক এবং সম্মিলিত।
প্রসূন জানালেন, এ মুহূর্তে ঢাকা ড্রিমের প্রি-প্রডাকশনের কাজ চলছে। আগামী ডিসেম্বরে শুরু হবে এর প্রথম পর্যায়ের দৃশ্যধারনের কাজ।
গল্পে আয়নাল ফকির নামে একজন রহস্যময় অন্ধ ভিক্ষুকের চরিত্রে অভিনয় করবেন ফজলুর রহমান বাবু। এছাড়া জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসতে বাধ্য হওয়া আরো কয়েকজন প্রান্তিক মানুষের চরিত্রে থাকবেন- নওশাবা, শাহাদাত, ইকবাল, সজীব, মুনিরা মিঠুসহ বেশ কিছু পরিচিত মুখ। এছাড়া আরো কয়েকটি বিশেষ চরিত্রে শিল্পী নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে। সুতপার ঠিকানার মতো ঢাকা ড্রিমেরও সংগীত পরিচালনা করছেন বরেণ্য শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ।
সম্প্রতি কুমার বিশ্বজিৎ এর নিজস্ব স্টুডিওতে শিল্পী বারী সিদ্দিকীর কন্ঠে একটি গান ধারন করার মাধ্যমে শুরু হয়েছে এর আনুষ্ঠানিক কাজ। ‘একদিন আমারও ছিল ঘর’ শিরানামের গানটিতে নদী ভাঙনে গৃহহারা একটি পরিবারের হাহাকার বিধৃত হয়েছে। ঢাকা ড্রিম নির্মিত হচ্ছে প্রসূন রহমানের নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা ইমেশন ক্রিয়েটর এর ব্যানারে।
সরকারী অনুদানে নির্মিত প্রসূন রহমান এর প্রথম পুর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র- সুতপার ঠিকানা মুক্তি পেয়েছে গত মে মাসে। শুধুমাত্র সিনেপ্লেক্স গুলোতে মুক্তি পাওয়ায় বিকল্প পদ্ধতিতে প্রদর্শন করছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
ডিসেম্বরে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পাচ্ছে মালয়েশিয়ার ৪টি সিনেপ্লেক্সে। এরমধ্যে ইন্দোনেশিয়ার ‘ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ফর পিস এন্ড ইকুয়ালিটি’তে জিতেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অফ মেরিট’ পুরস্কার। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে- ‘মায়ামি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভাল’, স্পেনের ‘আই ফিল্মমেকার ফেস্টিভাল’ এবং ‘দিল্লি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে’। ইটালির ‘লুমিয়ের ফিল্ম ফেস্টিভালে’ নির্বাচিত হয়েছে প্রতিযোগিতা বিভাগে।
আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্টিতব্য ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে’ও ছবিটি প্রদর্শিত হবে এশিয়ান সিনেমা বিভাগে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে গোয়া ফিল্ম ফেস্টিভালে।
নির্মাতার বক্তব্য
এই মুহুর্তের বাস্তবতায়- দেশব্যাপি কমপক্ষে ২০টি মাল্টিপ্লেক্স হওয়ার আগ পর্যন্ত আসলে জীবন ঘনিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো মানে হয়না। কারণ সিনেপ্লেক্সগুলো ছাড়া জীবন ঘনিষ্ট চলচ্চিত্র প্রদর্শনে আগ্রহী নয় কেউ। পোস্টারে বন্দুক-পিস্তলসহ নায়ক আর ভিলেন হিংস্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে না থাকলে সে ছবি প্রদর্শনে আগ্রহী নয় প্রদর্শকেরা। অন্য হলগুলোতে সুস্থ চলচ্চিত্রের দর্শকদের যাওয়ার মতো অবস্থাও নেই। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগীতা দরকার। সরকারের বিশেষ উদ্যোগ দরকার।
মননশীলতার চর্চা যদি না থাকে, একটি জাতি মননশীল হয়ে উঠবে কী করে? সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ও সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় প্রদর্শনের স্থান যদি না থাকে একটি জাতি সংস্কৃতিবান হয়ে উঠবে কী করে? সুশৃঙ্খল হয়ে উঠবে কী করে? নাগরিক সংস্কৃতির অনেকটা জুড়ে খাওয়া আর শপিং ছাড়া আর কোনো বিনোদন নেই এখন আমাদের।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা দিয়ে আমরা কাউকে অতিক্রম করতে পারবো না, সমকক্ষও হতে পারবো না। আমাদের কোনো কমপ্লিট ইনষ্টিটিউট নেই, হাফ-ইনষ্টিটিউট যেগুলো হচ্ছে- সেখানে যথার্থ রিসোর্স পার্সন নেই। আমাদের অগ্রগতি তাই একটু শ্লথগতির। কিন্তু যাত্রাটা অব্যাহত রাখতে হবে আমাদের পরিণত হয়ে উঠবার প্রয়োজনেই। চর্চাটা অব্যাহত রাখতে হবে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনেই। তাই এতো প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের এই নতুন উদ্যোগ, নতুন প্রচেষ্টা।
আমাদের আসলে গল্প বলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নিজেদের গল্পগুলো নিজেদের মতো করে বলতে হবে। আমাদের কাজে আমাদের সময়ের, আমাদের মানুষের একটা নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যদি না থাকে তাহলে সৃজনশীল কাজ করবার আসলে কোনো মানে হয়না। করলেও সেসব কাজ সৃজনশীল কাজ হিসেবে স্বীকৃত হবে বলেও মনে হয়না।
শুধুমাত্র গল্প ও বক্তব্যের শক্তিমত্তা দিয়ে ইরানী চলচ্চিত্র যে অর্থে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে, আমাদেরকে সেভাবে চেষ্টা করতে হবে। বৈশ্বিক বাজার ধরতে হবে। চলচ্চিত্র রপ্তানী করতে শিখতে হবে। সব ইন্ডাস্ট্রির কিছু সংকট থাকে, কিছু সমাধান হয়, আবার নতুন সংকট তৈরি হয়। এটি চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের সমস্যা অনেক, সে অনুযায়ী সমাধানের চেষ্টা এবং উদ্যোগ খুব কম। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নটাকে এগিয়ে নিতে হবে।
এলএ/পিআর