সাবরিনার জাল রিপোর্টে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে
করোনাভাইরাসের প্রভাবে থমকে গেছে সারা বিশ্ব। এই ভাইরাসকে চিহ্নিত করার জন্য করা হয় করোনা পরীক্ষা। বাংলাদেশে জেকেজি হেলথ কেয়ার করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করত। আর এই জেকেজির চেয়ারম্যান হলো বর্তমান সময়ের আলোচিত ব্যক্তি ডা. সাবরিনা আরিফ। জেকেজি স্যাম্পল কালেকশন করে তা পরীক্ষা না করে হাজার হাজার ভুয়া বা জাল সার্টিফিকেট প্রদান করেছে।
শুধু তাই নয়; বিদেশগামী বাংলাদেশি নাগরিকদের করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয় জাল বা ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করছে। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
সোমবার (১৩ জুলাই) ডা. সাবরিনা আরিফকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে চার দিনের রিমান্ড চেয়ে একটি প্রতিবেদনে দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (অপারেশন) হাসনাত খন্দকার। অপরদিকে সাবরিনার আইনজীবী সাইফুল ইসলাম তার জামিন চেয়ে আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রতিবেদনে এসব কথা উল্লেখ করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, মামলার আসামি ডা. সাবরিনা আরিফ জেকেজি হেলথ কেয়ার নামক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। তিনি তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মামলার ঘটনায় জড়িত তার অপরাপর সহযোগী আসামিদের নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম এবং লোগো ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে পজিটিভ জাল রিপোর্ট সরবরাহ করে নিরীহ লোকদের টাকা আত্মসাৎ করেন। এরকম অবহেলাজনিত কাজের সাহায্যে জীবন বিপন্নকারী রোগের সংক্রমণ বিস্তারে সহযোগিতা করে আসছেন তিনি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডা. সাবরিনা স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওপর বিভিন্ন সূত্রে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সরকারি কাজ পাইয়ে দিতেন। যার ফলশ্রুতিতে জেকেজি হেলথ কেয়ার বেপরোয়াভাবে সমাজে এইরূপ ক্ষতিসাধন করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিত মর্মে সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে।
ডা. সাবরিনা তার অপরাপর সহযোগীদের সহায়তায় করোনাভাইরাস মহামারির সময় অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে সমাজবিরোধী এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছেন। তার প্রতিষ্ঠান জেকেজি ঢাকা শহরসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোগীদের স্যাম্পল কালেকশন করে তা পরীক্ষা না করে হাজার হাজার ভুয়া সার্টিফিকেট (নেগেটিভ/পজিটিভ) প্রদান করেছে। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী বাংলাদেশি নাগরিকদের বিদেশে যাওয়ার পূর্বে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে জাল বা ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করা হয়েছে।
এদিকে আদালতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ডা. সাবরিনা বলেছেন, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। রিমান্ড শুনানি চলাকালে বিচারকের উদ্দেশে সাবরিনা বলেন, ‘জেকেজির চেয়ারম্যান আমাকে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি জেকেজির চেয়ারম্যান না। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি নির্দোষ।’ এ সময় ডা. সাবরিনাকে কান্না করতে দেখা যায়। আদালতের ভেতরে তিনি অস্থির ছিলেন। তার পক্ষে এক আইনজীবী জামিন চান। বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করেন।
শুনানিতে ডা. সাবরিনার আইনজীবী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ডা. সাবরিনা নির্দোষ। তাকে এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। সে ঘটনার সাথে জড়িত না। আমি তার জামিন চাই।’
মামলার বাদী কামাল হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি কল্যাণপুরে এক বাসার কেয়ারটেকার। আমার বাসার মালিক করোনা আক্রান্ত হন। বাসার মালিক আমাদের সাতজনকে করোনা পরীক্ষা করাতে বলেন। আমরা জেকেজি হেলথ কেয়ারে গিয়ে করোনা পরীক্ষা করে প্রতারিত হয়েছি। তাই আমি বাদী হয়ে একটি মামলা করেছি। দোষীরা শাস্তি পাক-এটা আমি চাই। তারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিলে খেলছে। তাদের বিচার হওয়া উচিত।’
গত রোববার দুপুরে আলোচিত চিকিৎসক সাবরিনাকে তেজগাঁও বিভাগীয় উপ-পুলিশ (ডিসি) কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
যেভাবে এল ডা. সাবরিনার নাম
রোববার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিসি মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘২২ জুন জেকেজির সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে আটক করে পুলিশ। হিরু আমাদের জানায়, সে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেটের ডিজাইন তৈরি করত। এই ভয়ানক তথ্য জানার পর আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি এর সাথে কারা জড়িত। সে স্বীকার করেছে, কোর্টেও ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে যে, ভুয়া রিপোর্টের সাথে জেকেজি গ্রুপের লোকজন জড়িত।’
ডিসি হারুন বলেন, “তখন জেকেজির সিইও আরিফুলসহ চারজনকে আটক করি। গ্রেফতার সিইওকে আমরা জিজ্ঞেস করি, ‘এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কে?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী।’ এরপর একে একে ছয়জনই এক উত্তর দিলেন।”
কে এই ডা. সাবরিনা
ডা. সাবরিনা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। পুলিশ বলছে, সাবরিনা জেকেজির চেয়ারম্যান। তবে সাবরিনা নিজেকে জেকেজির ‘চেয়ারম্যান’ নয় বরং প্রতিষ্ঠানটির ‘কোভিড-১৯ বিষয়ক পরামর্শক’ দাবি করেছেন।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সাবরিনা আরিফের চতুর্থ স্ত্রী। তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী রাশিয়া ও লন্ডনে থাকেন। তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তালাক হয়েছে তার। চতুর্থ স্ত্রী ডা. সাবরিনার কারণেই করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ পায় জেকেজি হেলথ কেয়ার। প্রথমে তিতুমীর কলেজ মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা এবং অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিলেন তারা।
সূত্র আরও জানায়, ঢাকা, নায়ায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল সাবরিনা-আরিফ দম্পতির জেকেজি প্রতিষ্ঠান। নমুনা সংগ্রহের জন্য মাঠকর্মী নিয়োগ দেয়া ছিল। তাদের হটলাইন নম্বরে রোগীরা ফোন দিলে মাঠকর্মীরা বাড়ি গিয়েও নমুনা সংগ্রহ করতেন। আবার অনেককে জেকেজির বুথের ঠিকানা দেয়া হতো। এভাবে কর্মীরা প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতেন।
পরে তাদের গুলশানের একটি ভবনের ১৫ তলার অফিসের একটি ল্যাপটপ থেকে ভুয়া সনদ দিত। ওই ল্যাপটপ থেকে জেকেজির কর্মীরা রাতদিন শুধু জাল রিপোর্ট তৈরির কাজ করতেন। প্রতিটা সনদের জন্য নেয়া হতো পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিদেশিদের কাছ থেকে নেয়া হতো ১০০ ডলার। যদিও শর্ত ছিল বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহ করে সরকার নির্ধারিত ল্যাবে পাঠাতে হবে। কিন্তু তারা সব ধরনের শর্তভঙ্গ করে পরীক্ষা ছাড়াই রিপোর্ট দিত।
এদিকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ডা. সাবরিনাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। রোববার (১২ জুলাই) মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত এক অফিস আদেশ জারি করা হয়।
জেএ/এসআর/জেআইএম