চোরাইপথে গরু এলে কপাল পুড়বে খামারিদের
করোনা মহামারির সময়ে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গবাদিপশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় খামারিরা। এ পরিস্থিতিতে তাদের ওপর আরও একটি দুশ্চিন্তা ভর করেছে। সেটা হলো- চোরাইপথে ভারত থেকে গরু আসা। গত কয়েক দিন ধরে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের স্রোতে ভেসে প্রতিদিন শত শত ভারতীয় গরু ঢুকছে বাংলাদেশে। এবার দেশে কোরবানির জন্য যে পশু প্রস্তুত করা হয়েছে, করোনা প্রার্দুভাবের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তারই বড় একটা অংশ অবিক্রিত থেকে যাবে। তার ওপর চোরাইপথে গরু আসলে খামারিদের কপাল পুড়বে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এবার ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য ১ কোটি ১০ লাখ গবাদিপশু দরকার হবে। কিন্তু সারাদেশে খামারগুলোতে ১ কোটি ১৯ লাখ গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি হিসাবেই চাহিদার তুলনায় ৯ লাখ গবাদিপশু বেশি। এছাড়া গত বছর কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল ১ কোটি ১৮ লাখ পশু। এর মধ্যে ১ কোটি ৬ লাখ পশু কোরবানি হয়েছিল। সে হিসাবে গত বছরেরও ১২ লাখ পশু অবিক্রিত রয়েছে।
দেশের গরু-ছাগলের খামারিদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমারস অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, সরকার এবার কোরবানির হাটের যে চাহিদা নিরূপণ করেছে, তা থেকেও ২০ শতাংশ গবাদিপশু কম বিক্রি হবে। কারণ, ক্রেতাদের হাতে টাকা নেই। খামার থেকে হাটে গরু নিয়ে আসার মতো পুঁজি নেই। এবার ট্রাক ভাড়াও বেশি।
বাংলাদেশ ডেইরি ডেভলপমেন্ট ফোরামের (বিডিডিএফ) সাধারণ সম্পাদক ও সাদিক এগ্রো লিমিটেডের মালিক ইমরান হোসেন বলেন, দেশের ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ মানুষ এবার কোরবানি দিতে পারবে না। করোনা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের কারণে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ।
এদিকে গত তিন মাসে করোনা পরিস্থিতির কারণে নিয়মিত বাজারে অর্ধেকের কম গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে। এই অবিক্রিত গরুগুলো কোরবানির হাটে ওঠার অপেক্ষায় আছে। এগুলোর পরিমাণ ১০ থেকে ১৫ লাখ। সবমিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে যে পশু আছে সেখান থেকেই প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ লাখ পশু এবার অবিক্রিত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় ভারত থেকে চোরাই পথে পশু আসা মানে দেশের খামারিদের সর্বনাশ ডেকে আনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলার সীমান্তপথে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে প্রতি রাতে শত শত গরু ও মহিষ দেশের সীমানায় প্রবেশ করানো হচ্ছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দই খাওয়া, উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়ন এবং নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের সীমান্তের নদীপথে প্রচুর ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এসব গরু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলার হাটগুলোতে বিক্রির জন্য তোলা হচ্ছে। সেখান থেকে ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট জেলার গরু ব্যবসায়ীরা।
তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলছে, সীমান্তে নজরদারিসহ টহল জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া ও নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে চোরাকারবারিরা বিভিন্নভাবে সীমান্তের নদীপথে গরু প্রবেশ করাচ্ছে। গরুর লট প্রবেশের খবর পাওয়া মাত্র তা সিজ করা হচ্ছে।
আরও জানা গেছে, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর হাটে দেশি গরুর চেয়ে ভারতীয় গরু-মহিষের সমাগম বেশি। পানিপথ অতিক্রম করা এসব গরুর গায়ে বিশেষ চিহ্ন দিয়ে সেগুলো প্রকাশ্যে বিক্রির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। আবার অনেক গরু ট্রাক বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হাটে কোনো অনুমোদিত বিট বা খাটাল ব্যবস্থা না থাকলেও সেখানে গরুপ্রতি ১৫০ টাকা করে বিট আদায় করছে একটি চক্র।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যাত্রাপুর হাটের একাধিক ভারতীয় গরু বিক্রেতা জানান, বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক আবহাওয়ায় প্রতি রাতে দেড় থেকে দুইশ গরু ভারতীয় সীমান্ত হতে নদীপথে বাংলাদেশের জলসীমায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। তবে আবহাওয়া খারাপ হলে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। সীমান্ত পথে জলসীমানায় নির্বিঘ্নে গরু প্রবেশ করাতে লাইনম্যানদের গরুপ্রতি নির্দিষ্ট হারে (বাছুরপ্রতি ৫০০ ও বড় গরু এক হাজার) টাকা প্রদান করা হয়। এরপর ব্যবসায়ীরা তাদের গরু ডাঙায় তুলে হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। ইজারাদারদের গরুপ্রতি ৩৫০ টাকা দিয়ে এসব গরু বিক্রি করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার (৯ জুলাই) এক অনলাইন সভায় মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, এবার কোরবানির জন্য কোনো অবস্থাতেই বিদেশ থেকে গবাদিপশু আনার অনুমতি দেয়া হবে না।
তিনি বলেন, আসন্ন কোরবানির ঈদের জন্য দেশে ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি গবাদিপশু মজুত রয়েছে। যার মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৩ লাখ ৫৫ হাজার ও অন্যান্য ৪ হাজার ৫০০টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত।
প্রাণীসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আবদুল জব্বার শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, যেহেতু এবার দেশের পরিস্থিতিটা অস্বাভাবিক সে কারণে অন্য বছরগুলোর তুলনায় কোরবানির সংখ্যা কম হবে। এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দা।
তিনি আরও বলেন, ভারত থেকে গরু আনার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে যে পশু প্রস্তুত করা হয়েছে তা যথেষ্ট। তবে চোরাই পথে এলে সেটা অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখবেন।
বাংলাদেশ ডেইরি ডেভলপমেন্ট ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা কোনোভাবেই চাই না যে ভারত থেকে কোরবানির পশু বাংলাদেশে আসুক। এমনিতেই এবার খামারিদের অবস্থা নাজুক। কারণ করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে। অনেকেই কোরবানি দিতে পারবে না। সরকার ভারত থেকে কোনো পশু আনছে না। তবে চোরাই পথে এলে সেটাকে স্থানীয় প্রশাসনের থামানো উচিৎ।
এফএইচএস/এমএসএইচ/এমএস