চলছিল নির্বিচার গুলি, রক্তনদীতে মরার মতো পড়ে থেকে বাঁচলেন তিনি
মানবপাচারকারী ও মিলিশিয়াদের নির্বিচারে ছোড়া গুলিতে যখন একের পর এক সহযাত্রীরা সামান্য গোঙানি দিয়ে নিথর হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন বেঁচে থেকেও রক্তনদীতে লাশের মতো পড়েছিলেন তিনি। এক সময় গুলি থামে। হামলাকারীরা চলে যায়। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে, তখনো তিনি লাশের মতোই পড়েছিলেন। শুরুতে লাশ ভাবলেও উদ্ধারকারীরা বুঝতে পারেন তিনি বেঁচে আছেন। এরপর তারা তাকে খাবার-পানীয় দেন। আহতদের সাথে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের বিশ্বাস করতে না পেরে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন তিনি। পরে একজন লিবিয়ানের কাছে আশ্রয় নেন।
গত বৃহস্পতিবার (২৮ মে) লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের বর্বরোচিত আক্রমণে ২৬ বাংলাদেশি নিহত ও ১১ জন আহত হওয়ার ঘটনায় তিনিই একমাত্র অক্ষত বাংলাদেশি। তার নাম সায়েদুল ইসলাম। বাড়ি মাদারীপুর জেলার রাজৈরের। ঘটনার পর তিনি নিজের সুরক্ষায় আত্মগোপনে থেকেছেন। তবে ফোনে বাংলাদেশ দূতাবাসকে সব তথ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। দুইদিন পরে গতকাল শনিবার (৩০ মে) রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের মিজদাহ অঞ্চল থেকে তাকে উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ দূতাবাস।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। দূতাবাস কর্মকর্তাদের কাছেই হামলার ওই মুহূর্তের কথা জানিয়েছেন সায়েদুল।
তার সে বর্ণনা দূতাবাস কর্মকর্তারা জাগোনিউজের কাছে তুলে ধরেন। তারা জানান, গুলি না লাগলেও উদ্ধার হওয়া সায়েদুল ইসলাম মারাত্মকভাবে আহত। কারণ অন্তত ১০-১৫ দিন ধরে মানবপাচারচক্র তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। বর্তমানে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
সায়েদুলের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারত ও দুবাই হয়ে তিনি লিবিয়াতে পৌঁছান। তিনি ঠিক কবে লিবিয়ায় পৌঁছান সেটা বলতে পারেননি। তবে তিন থেকে চার মাস আগে সেখানে পৌঁছেছেন বলে কর্মকর্তাদের জানান তিনি।
সায়েদুল জানান, দিন পনের আগে বেনগাজী থেকে ৩৮ জন বাংলাদেশি ও কয়েকজন সুদানিজকে নিয়ে ত্রিপোলির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় পাচারকারীরা। পথিমধ্যে মিজদাহ শহরে তাদের আটক করে মুক্তিপণ দাবি করে নির্যাতন চালাতে থাকে। ১০-১৫ দিন ধরেই তাদের ওপর চলছিল অমানবিক নির্যাতন।
ঘটনার দিনও অপহরণকারীরা নির্যাতন করতেই তাদের কাছে এসেছিল। পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী সুদানের নাগরিকরা তাদের প্রতিরোধ করে এবং পাল্টা হামলা চালায়। এতে অপহরণকারীদের নেতার মৃত্যু হয়। তখন অপহরণকারীর সহযোগীরা তাদের আটকে রেখে অন্যদের খবর দেয়।
সায়েদুলের ধারণা অপহরণকারীদের নেতার বাড়ির কাছেই একটি গ্যারেজের মত জায়গায় তাদের আটক করে রাখা হয়েছিল। কারণ, ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাড়ির লোকজন বন্দুক হাতে সেখানে আসে এবং নির্বিচারে গুলি করতে থাকে।
নৃশংস হত্যাযজ্ঞ থামার পর সায়েদুল পালিয়ে গিয়ে নিজের অবস্থান গোপন রাখেন। কারণ অপহরণকারীরা বিরাট একটি চক্র। তাছাড়া গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিতে কেন্দ্রীয় কোনো সরকার না থাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো নয়।
বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মীরা জানান, উদ্ধারের পরপরই সায়েদুলকে লিবিয়ার আদালতে নেয়া হয়। সেখানে তার জবানবন্দি নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি শারীরিক এবং মানসিকভাবে অত্যন্ত বিধ্বস্ত হওয়ায় জবানবন্দি দিতে পারেননি। আপাতত দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলবে।
কর্মকর্তারা জানান, এ ঘটনায় লিবিয়ার পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। তবে ঘটনাটি ঘটেছে মিজদাহ শহরে, যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত জিএনএ সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে ঘটায় এর কোনো বিচার হবে বলে মনে করেন না তারা।
এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জাগো নিউজকে বলেছিলেন, আহত ১১ জনের মধ্যে ছয়জনের অবস্থা স্থিতিশীল। বাকি পাঁচজন গুরুতর আহত।
তবে ওই পাঁচজনের মধ্যে একজনের অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন দূতাবাস কর্মকর্তারা। ওই বাংলাদেশির নাম মো. বাপ্পি। বাকিরা ধীরে ধীরে শঙ্কামুক্ত হচ্ছেন।
জানা যায়, বাপ্পি মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মাথায় অপারেশনের পরে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি বাংলাদেশির শরীরে অমানবিক নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে।
জেপি/এইচএ/জেআইএম