লিবিয়ার ঘটনায় হতাহত বাংলাদেশিদের পরিচয় মিলেছে
লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের এক সদস্যের সহযোগী ও স্বজনদের বর্বরোচিত আক্রমণে হতাহত বাংলাদেশিদের পরিচয় মিলেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ওই ঘটনায় ২৬ বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১১ জন।
হতাহতদের মধ্যে ‘নিখোঁজ বা মৃত’ হিসেবে সম্ভাব্য ২৩ জনের এবং আহত হিসেবে ১১ জনের পরিচয় প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া অক্ষত অবস্থায় পালাতে সক্ষম বাংলাদেশির নামও জানানো হয়েছে।
নিখোঁজ বা মৃত সম্ভাব্য ২৩ জনের তালিকার ১১ জনই মাদারীপুরের। তারা হলেন- মাদারীপুরের জাকির হোসেন, জুয়েল ও ফিরোজ, একই জেলার রাজৈরের বিদ্যানন্দীর জুয়েল ও মানিক, টেকেরহাটের আসাদুল, আয়নাল মোল্লা ও মনির, ইশবপুরের সজীব ও শাহীন, দুধখালীর শামীম।
এ ছাড়া নিহতদের তালিকায় রয়েছে গোপালগঞ্জের সুজন ও কামরুল; ঢাকার আরফান; কিশোরগঞ্জের ভৈরবের রাজন, শাকিল, সাকিব মিয়া ও সোহাগ, মো. আলী, রসুলপুরের আকাশ, হোসেনপুরের রহিম, যশোরের রাকিবুল মাগুরার লাল চান্দ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, নিহত বাকি তিনজনের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। তাদের পরিচায় অনুসন্ধান করছে বাংলাদেশ দূতাবাস।
আহত ১১ জন হলেন- মাদারীপুর সদরের তীর বাগদি গ্রামের ফিরোজ বেপারী (হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ), ফরিদপুরের ভাঙ্গার দুলকান্দি গ্রামের মো. সাজিদ (পেটে গুলিবিদ্ধ), কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শম্ভপুর গ্রামের মো. জানু মিয়া (পেটে গুলিবিদ্ধ), ভৈরবের জগন্নাথপুর গ্রামের মো. সজল মিয়া (দুই হাতে মারাত্মকভাবে জখম ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন), গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বামনডাঙ্গা বাড়ির ওমর শেখ (হাতে মারাত্মকভাবে জখম ও আঙ্গুলে কামড়ের দাগ, দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ), মাগুরার বিনোদপুরের নারায়ণপুরের মো. তরিকুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গার বাপ্পি মিয়া (মাথায় গুলিবিদ্ধ, গুরুতর অবস্থা), একই জেলার আলমডাঙ্গার বেলগাছির খেজুরতলার মো. বকুল হোসাইন (৩০), কিশোরগঞ্জের ভৈরবের সখিপুরের মওটুলীর সোহাগ আহমেদ (২০), মাদারীপুরের রাজৈরের ইশবপুরের মো. সম্রাট খালাসী (২৯)। তারা সবাই ত্রিপোলি মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এ ছাড়া যে বাংলাদেশি অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে লিবিয়ানের আশ্রয়ে আছেন তার নাম সায়েদুল ইসলাম বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার (২৮ মে) লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মিজদাহ-তে (ত্রিপলি হতে ১৮০ কি.মি. দক্ষিণে) লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী অপহরণকৃত বাংলাদেশিদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালালে আনুমানিক ২৬ জন বাংলাদেশি ঘটনাস্থলে নিহত হন।
আক্রান্তদের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এক বাংলাদেশির বরাতে বিবৃতি বলা হয়, ১৫ (পনের) দিন আগে বেনগাজী থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে কাজের সন্ধানে মানবপাচারকারীরা এসব বাংলাদেশিকে ত্রিপোলিতে নিয়ে আসার পথে তিনিসহ মোট ৩৮ জন বাংলাদেশি মিজদাহ শহরে নিকট লিবিয়ান মিলিশিয়া বাহিনীর একদল দুষ্কৃতকারীর হাতে জিম্মি হন। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে জিম্মিকারীকর্তৃক অমানবিক নির্যাতনের একপর্যায়ে অপহৃত ব্যক্তিবর্গদ্বারা মূল অপহরণকারী লিবিয়ান নিহত হয়। এর প্রতিশোধ নিতে লিবিয়ান মিলিশিয়া বাহিনী তাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এতে ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত হন এবং আরও ১১জন বাংলাদেশি হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে গুলিবিদ্ধ হন।
মন্ত্রণালয় জানায়, মরদেহগুলো মিজদাহ হাসপাতালের মর্গে সংরক্ষণের ব্যবস্থার পাশপাশি দূতাবাসের সহায়তায় আহতদের উন্নততর চিকিৎসার জন্য ত্রিপোলিতে হাসপাতালে আনা হয়েছে। গুরুতর আহত তিনজনের শরীর হতে গুলি বের করার জন্য অস্ত্রোপচারের করা হয়েছে।
আহতদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস লিবিয়ার স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এবং আইওএম লিবিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখছে এবং তারা আহত ব্যক্তিদের জন্য সম্ভাব্য সহায়তা দিচ্ছে।
দূতাবাস লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরো ঘটনার তদন্তসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার, দোষীদের যথাযথ শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যও অনুরোধ জানিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে, লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিজদাহের সুরক্ষা বিভাগকে অপরাধীদের গ্রেফতার এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, মিজদাহ শহরে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান এবং এ অঞ্চলটি এখন দুটি শক্তিশালী পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে। কিছুদিন আগে ত্রিপোলিভিত্তিক এবং ইউএন সমর্থিত জিএনএ সরকার এই অঞ্চলটি দখল করে নিলেও জেনারেল হাফতারের নেতৃত্বাধীন পূর্বভিত্তিক সরকারি বাহিনী দু'দিন আগেও শহরটিতে বোমাবর্ষণ করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারের এ অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। বর্তমানে এমনকি ত্রিপোলি শহরেও বিরোধীপক্ষ মাঝেমাঝে বোমাবর্ষণ করে থাকে। দুটি শক্তিশালী পক্ষ যুদ্ধরত থাকায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক নয়। এ কারণে অধিকাংশ দেশ তাদের দূতাবাস তিউনিসিয়াতে স্থানান্তর করলেও বাংলাদেশসহ মাত্র তিনটি দেশ তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় বাংলাদেশ সরকার সব প্রকার মানব পাচারের সম্পূর্ণরূপে বিরোধী এবং মানব পাচার রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার ফলে বাংলাদেশ হতে মানব পাচারের পরিমাণ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এ সমস্যাকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের লক্ষ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধিরসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একসাথে কাজ করা প্রয়োজন।
জেপি/এইচএ/পিআর