ইউনাইটেডে অগ্নিকাণ্ড : মিলছে না অনেক প্রশ্নের উত্তর

আদনান রহমান
আদনান রহমান আদনান রহমান , জসীম উদ্দীন জসীম উদ্দীন
প্রকাশিত: ০৮:২১ পিএম, ২৮ মে ২০২০

রাজধানীর গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীদের জন্য অস্থায়ীভাবে নির্মিত আইসোলেশন ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডে ঝরেছে পাঁচজনের প্রাণ। তাদের মধ্যে তিনজন করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। বাকি দুইজন শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি ছিলেন সেখানে। এ ঘটনায় দায়িত্বহীনতা, অবহেলা, গাফেলতিসহ বিস্তর অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে।

অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া মাহবুব এলাহী চৌধুরী নামের এক রোগীর চিকিৎসায় অবহেলা, আগুন লাগার পর সময় মতো ফায়ার সার্ভিসকে খবর না দেয়া, করোনা ইউনিটে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, আগুন নেভাতে ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার না করা, পার্টেক্স বোর্ড দিয়ে করোনা ইউনিট তৈরি, ইউনিটের জন্য ব্যবহৃত ১২টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ৯টিই মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার মতো অভিযোগের তীরের সামনে ইউনাইটেড হাসপাতাল। এর মধ্যে আবার মৃত রোগীদের পরিবারের সঙ্গে কথা না বলেই অপমৃত্যুর মামলা করার মতো কাজ তাদের ফেলেছে আরও কড়া সমালোচনায়। বুধবার (২৭ মে) রাতে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে এসব বিষয়ে অবশ্য কিছু ব্যাখ্যা দিয়ে আসছে তারা।

দুইবার করোনা নেগেটিভ, তবু করোনা ইউনিটেই করুণ মৃত্যু
আগুনে মারা যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে মাহবুব এলাহীকে গত ১৫ মে শ্বাসকষ্টের কারণে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করে পরিবার। তাকে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি রেখে ১৬ মে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে করোনা টেস্ট করানো হয়। ছয়দিন পর ২১ মে সকালে টেস্টের রিপোর্ট আসে। রিপোর্টে তার করোনা ‘পজিটিভ আসে’। একই দিন বিকেলে আবার টেস্টে ফলাফল ‘নেগেটিভ’ আসে। অর্থাৎ তার করোনা ছিল না। তবু তার শ্বাসকষ্ট ছিল। ২২ মে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ আবারও তার রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে করোনা টেস্ট করে। ২৩ মে বিকেলে তার রিপোর্ট আবারও ‘নেগেটিভ’ আসে। এবারও জানা গেল তিনি করোনায় আক্রান্ত নন।

এ বিষয়ে মাহবুব এলাহীর পরিবারের অভিযোগ, শ্বাসকষ্টের কারণে তাকে বারবার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করতে বলা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা কানে তোলেনি। ‘নেগেটিভ’ রিপোর্টের রোগীকে তখনো করোনা ইউনিটে রাখা হয়। ২৪ মে যোগাযোগ করা হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলে, আরেকবার স্যাম্পল নিতে হবে, এরপর সিদ্ধান্ত।

jagonews24

১২ দিন এই করোনা ইউনিটেই ছিলেন মাহবুব। ২৫ মে ঈদের দিন আবারও নমুনা সংগ্রহ করা হয় তার। তবে সেই ফলাফল দেয়ার আগেই আগুনে মৃত্যু হয় তার।

এ বিষয়ে মাহবুবের মেয়েজামাই সাইফুল ওসমান জাগোনিউজকে বলেন, আমরা তার চিকিৎসা পাওয়ার জন্য কোনো কম্প্রোমাইজ করিনি। শ্বাসকষ্টের কারণে ইউনাইটেডের আগে প্রথমে আমরা তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে (অ্যাপোলো হাসপাতাল) নিই। তারা সেখানে ভর্তি না রাখলে এখানে আনি। প্রতিদিন ৩০-৩৫ হাজার টাকা জমা করতে করতে ইতোমধ্যে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছি। তবু এমন দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলো। দুই-দুইবার করোনা নেগেটিভ আসার পর তাদের বারবার বলা সত্ত্বেও তারা তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করেনি। এখন আর কার কাছে কী অভিযোগ করবো? আক্ষেপ একটাই তার মরদেহ হস্তান্তরের সময় কাগজে ‘করোনা নেগেটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ করোনা ইউনিটেই মৃত্যু হলো।

এ বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের কমিউনিকেশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ডা. সাগুফা আনোয়ার জাগোনিউজকে বলেন, রোগীর লক্ষণ-উপসর্গে কোভিড-১৯ এর ইঙ্গিত ছিল। এক্স-রে রিপোর্টেও তার কোভিডের উপস্থিতি প্রকাশ পায়, তবে কোভিড টেস্টে ফলাফল ‘নেগেটিভ’ এসেছে, যেটা ‘ফলস নেগেটিভ’ও হতে পারে। বিশ্বব্যাপী এ ধরনের লক্ষণ-উপসর্গ দেখলে কোভিডের চিকিৎসা দেয়া হয়। আমরা এ বিষয়ে রোগীর পরিবারের সাথে কথা বলেছি। তারা এখানে (আইসোলেশন ইউনিট) রেখেই চিকিৎসা করাতে রাজি হন। তার পরিবারের অনুরোধেই আমরা তাকে প্লাজমা থেরাপি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তার পরিবারের লোকজনও প্লাজমা ডোনারের খোঁজে ছিলেন।

করোনা ইউনিটে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ
বুধবার রাতে অগ্নিকাণ্ডের পর বৃহস্পতিবার (২৮ মে) সকালে অগ্নিকাণ্ডস্থল পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস ও সিআইডির ফরেনসিক টিম। তারা সেখানে দেখে, করোনা রোগীদের জন্য তৈরি করা ইউনাইটেড হাসপাতালের মূল ভবনের বাইরে আইসোলেশন ইউনিটের জন্য যে ১২টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা হয়েছে, তার নয়টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। পরে তা আলামত হিসেবে জব্দ করে সিআইডি।

আইসোলেশন ইউনিটের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপ-পরিচালক ও ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান দেবাশীষ বর্ধন জাগোনিউজকে বলেন, ইউনাইটেড হাসপাতাল করোনা রোগী রাখার জন্য আলাদা আইসোলেশন করতে সরকারিভাবে নির্দেশনা পেয়েছে, তাই করার জন্য করেছে আর কি। এই ইউনিটটা খুবই রিস্কি ছিল। যে পাঁচজন মারা গেছেন তারা সানসেটের ঠিক নিচে ছিলেন। আর বাইরে একটা এক্সটেনশন আছে টিনশেডের। অস্থায়ীভাবে তৈরি ওই ইউনিটের পার্টিশনগুলো পার্টেক্স জাতীয়, যা অতিদাহ্য। আগুন যখন লেগেছে তাৎক্ষণিকভাবে একসঙ্গে পুরোটায় লেগে গেছে। এ কারণে একটা রোগীও বের হতে পারেননি। তাছাড়া, করোনা রোগীর আশপাশে সাধারণত কেউ থাকে না। ওখানে ওই পাঁচজন রোগীই চিকিৎসাধীন ছিলেন। যখনই আগুন লেগেছে তখন তারা আর বের হতে পারেননি।

jagonews24

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ওইভাবে ছিল না। কিন্তু করোনা ইউনিটের পাশেই ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বোধয় ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার করতে পারেনি। তাই প্রথমে তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

ফায়ার সার্ভিসকে ডাকতে ২৫ মিনিট বিলম্ব
ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় রাত ৯টা ৩০ মিনিটে। আর ফায়ার সার্ভিস বলছে, তাদের কাছে খবর যায় ৯টা ৫৫ মিনিটে। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে ২৫ মিনিট কেন সময় লেগেছিল? ফোন দেয়া কার দায়িত্ব ছিল, আর এই ২৫ মিনিটে কেন আগুন নেভানো যায়নি? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না ইউনাইটেড হাসপাতালের তরফ থেকে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, আমরা ৯টা ৫৫ মিনিটে আগুনের সংবাদ পেয়ে ১০টা ৪ মিনিটে ইউনাইটেডে প্রবেশ করে তা নিয়ন্ত্রণে কাজ করি। ফায়ার টিম এসেই দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলে। যেই স্থানে আগুন লেগেছে, সেখানে আমরা আগেও মহড়া করেছিলাম।

এদিকে পুলিশ বলছে, ইউনাইটেড হাসপাতাল নয় বরং একজন রোগীর স্বজন জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ দেন । পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী এ বিষয়ে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় এক রোগীর স্বজন গেইটে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি ৯টা ৪৮ মিনিটে আগুন দেখে ৯৯৯-এ ফোন করেন। আমরা তার ফোন চেক করেছি। পরবর্তীতে ভাটারা থানার মাধ্যমে আমরা ফায়ার সার্ভিসকে দ্রুত মেসেজ পাঠাই। তবে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছানো পর্যন্ত সময়ে হঠাৎ করেই আগুন বড় পর্যায়ে চলে যায়, এর ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে আগুন নেভানো সম্ভব হয়নি।

ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দেয়ার ক্ষেত্রে বিলম্বের বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের কমিউনিকেশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ডা. সাগুফা আনোয়ার বলেন, এই অভিযোগ সত্য নয়, আমরা তৎক্ষণাৎ ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দেই। ফায়ার সার্ভিস দেরি করে এলো কেন এটি দেখার বিষয়।

তাড়াহুড়ো করে অপমৃত্যু মামলা
হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডস্থল থেকে মরদেহগুলো রাত সোয়া ১০টায় উদ্ধার করা হয়। তবে এর প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গুলশান থানায় অপমৃত্যুর মামলা করে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। সাধারণত অপমৃত্যুর মামলার ক্ষেত্রে মৃতের স্বজনদের কোনো অভিযোগ আছে কি-না এ বিষয়ে কথা বলা হয়। কিন্তু এই পাঁচজনের স্বজনদের সঙ্গে কোনো কথা না বলেই রাত সাড়ে ১১টায় মামলা করে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দুইজন রোগীর স্বজন জাগোনিউজকে নিশ্চিত করেছেন যে, তারা অপমৃত্যুর মামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাদের কাছে কিছু জানতে চাওয়া হয়নি।

jagonews24

নেটিজেনরাও দুষছেন ইউনাইটেডকে
একটি পাঁচ তারকা মানের হাসপাতালে আগুনে এভাবে মানুষের মৃত্যুর পেছনে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবের কথাই বলছেন নেটিজেনরা।

আগুনে মৃত্যুবরণকারী মাহবুব এলাহীর আবু সায়েম শাহীন নামে এক ছোটভাই ফেসবুকে পোস্ট করেছেন-
“#বিচারচাই
একটা কথা বলতে চাই আপনাদের সবার উদ্দেশ্যে, আজ আমার এক বড় ভাই উনি ইউনাইটেড হাসপাতালে যে দুর্ঘটনা হয়েছে ওই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, অবাক করার বিষয় উনি ১৪ দিন ধরে ওই হসপিটালে অ্যাডমিট ছিলেন, দুই দুইবার ওনার করোনা নেগেটিভ আসছে, নেগেটিভ আসার কারণে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করতে চেয়েছে তার পরিবার, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওনাকে রিলিজ দেয় নাই। এখন আমার প্রশ্ন কী কারণে তাকে রিলিজ দেওয়া হলো না? আর আজকে এই আগুনের কারণে করুণ মৃত্যু তার দায় কে নেবে? হসপিটাল এই পাঁচজন লোককে কি বাঁচাতে পারত না? এটা কেমন ব্যাপার? হসপিটালে মানুষ বাঁচানোর জন্য নেওয়া হয় এইভাবে মানুষ মারার জন্য নয়! আমরা এটার সুষ্ঠু বিচার চাই, এইভাবে কেউ যেন আগুনে পুড়ে বা বিশ্বাস করে হসপিটালে ভর্তি হয়ে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার না হয়, বিচার চাই হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট এর বিরুদ্ধে, এরকম একটি ভালো লোকের মৃত্যু এভাবে হতে পারে না। ধিক্কার জানাই ইউনাইটেড হসপিটালকে, এরকম ম্যানেজমেন্টের বিচার চাই,
#শেয়ারকরুন”

সাংবাদিক আমানুর রহমান রনি লিখেছেন, “প্রশ্নটা নিষ্ঠুর হলেও করতে মন চায়। একটি ওয়ার্ডের পাঁচজন রোগীই মারা গেল, আর আপনাদের হসপিটালের একজন স্টাফ বা অন্য কেউ আহত হলো না! তখন কি ওয়ার্ডে কেউ ছিলেন না! ইউনাইটেডের লিখিত প্রেস রিলিজে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কী ছিল? থাকলে সেগুলে দিয়ে কি কেউ চেষ্টা করেছিল?”

সাংবাদিক শাহদাত পারভেজ লিখেছেন, “এমনিতেই করোনা। তার ওপর মরার আগুন। গলাকাটা ইউনাইটেডের করোনা ইউনিটের এসির যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ হাসপাতালগুলোর কী অবস্থা ভাবুন। ফায়ার সার্ভিসের সূত্রে জানা গেছে, সেখানে অগ্নিনির্বাপণের যথেষ্ট সুযোগ ছিল না।হতভাগ্য এই মানুষগুলো করোনা থেকে বাঁচতে গিয়েছেলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে। আর বের হলেন কয়লা হয়ে। যারা মারা গেলেন তাদের পরিবার এর বিচার পাবে তো?”

এআর/এইচএ/এমকেএইচ

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।