কৃষিপণ্য বিপণনে চালু হলো ‘ফুড ফর নেশন’

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৩৭ পিএম, ২৩ মে ২০২০

দেশের খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, চাহিদা মোতাবেক সহজলভ্যতা তৈরি এবং জরুরি অবস্থায় ফুড সাপ্লাই চেইন অব্যাহত রাখতে প্রথম উম্মুক্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ফুড ফর নেশন’ চালু করেছে সরকার।

শনিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষ থেকে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের (জুম প্ল্যাটফর্মে) মাধ্যমে সরকারি সেবা পোর্টাল উদ্বোধন করেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। এ অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ঠিকানা- foodfornation.gov.bd। ‘ফুড ফর নেশন’ প্ল্যাটফর্মটি তৈরি ও সমন্বয়ের কাজ করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এটুআই এবং উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প এবং কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি বিপণন অধিদফতর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এছাড়া সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন, ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘মহামানি করোনার কারণে মৌসুমী ফল ও শাক-সবজি স্বাভাবিক পরিবহন ও সঠিক পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল সময় মতো বিক্রি করতে পারছে না। অনেকে বিক্রি করেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে আম, লিচু, কলা পেপের, সবজি ও পানের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এই দুই দুর্যোগের কারণে কৃষি পণ্যের বাজারজাত সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।’

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের ব্যবস্থাপনায় যে নতুন চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এসেছে তা মোকাবেলায় এই উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মটি বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমি আশা করি।’

আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, অন্যদিকে বাংলাদেশের উৎপাদিত শাক-সবজি, মৌসুমী ফলসহ কৃষি পণ্যের একটি বিরাট অংশ বিপণনের অভাবে প্রতিবছর অপচয় ও নষ্ট হয়। এই প্ল্যাটফর্মটি যথাযথভাবে কাজ করলে কৃষিপণ্যের অপচয় রোধেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। ‘ফুড ফর নেশন’ প্ল্যাটফর্ম বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি বিপণন অধিদফতর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সার্বিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাবে বলে আমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি ও জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

‘কৃষি বিপণন অধিদফতর সকল কৃষিপণ্যের পাইকারি ও খুচরা বাজারদর, সরবরাহ, চলাচল, মজুদের তথ্য সরবরাহ এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সমন্বয় করবে। এছাড়া খাদ্যশস্য ও কৃষি পণ্যের বাজারদর নিয়মিত মনিটরিংসহ বাজারদরের ওঠানামার কারণ চিহ্নিত করে তা নিয়ন্ত্রণসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এই প্ল্যাটফর্মের সাথে সমন্বয় করবে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের অ্যাপকে এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সমন্বয় করে কৃষিপণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করবে।’

কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন সংশ্লিষ্ট খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য তাদের পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহারের জন্য স্বল্প বা বিনামূল্যে বিশেষ মূল্যে সুবিধা দেবে।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করা, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। এপ্রিল মাসে এ বিষয়ে প্রথম বৈঠক করেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘পরে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ অংশীজনদের নিয়ে আরেকটি মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বাংলাদেশে একটি ওপেন শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবো। যেখানে কৃষক, উৎপাদক ও যারা ব্যবসায়ী আছেন তারা যাতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতে পারেন। পাশাপাশি দেশের ১৭ কোটি মানুষ তারা শহর বা গ্রামে যেখানেই থাকেন না কেন ন্যায্যমূল্যে তাদের বাড়িতে যেন পণ্যটা পৌঁছে দেয়া যায়। সেজন্যই আমার ফুড ফর নেশন- এই উদ্যোগটি নিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সুন্দরভাবে পৌঁছে দেয়া।’

এই প্ল্যাটফর্মে শুধু বিক্রেতারই তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেবেন তা নয়, এখানে ক্রেতারা কী কিনতে চান সেই বিজ্ঞাপনও দিতে পারবেন বলে জানান পলক।

প্ল্যাটফর্মে যা থাকছে, ব্যবহার যেভাবে
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রথম উন্মুক্ত কৃষিপণ্য মার্কেটপ্লেস ‘ফুড ফর নেশন’ নিয়ে উপস্থাপনা দেন এটুআই প্রোগ্রামের হেড অফ রুরাল ই-কমার্স রেজওয়ানুল হক জামি। তিনি জানান, গত ২০ এপ্রিলের এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একশপ, স্টার্টআপ বাংলাদেশ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষি বিপণন অধিদফতর একসঙ্গে কাজ শুরু করে। সারা দেশে কৃষি বিপণন ব্যবস্থার ম্যাপিং ও পাইলট চালান শুরু হয়। রেকর্ড সময়ের মধ্যে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে সমন্বয় করে প্ল্যাটফর্মটি প্রস্তুত করা হয়।

তিনি বলেন, ‘প্ল্যাটফর্মটি এমনভাবে বানানো হয়েছে যেন তা মোবাইল ও কম্পিউটারের মাধ্যমে সমানভাবে ব্যবহার করা যায়। অচিরেই প্ল্যাটফর্মটি অ্যাপ হিসেবে পাওয়া যাবে।’

এলাকায ও ফসল/পণ্য ভিত্তিক কৃষি ব্যবসায়ীদের একটি ডাটাবেজ সংযুক্ত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যা প্রতিনিয়ত আপডেট করা হবে। এই ডাটাবেজে আড়ৎদার, মৌসুমী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে এলাকাভিত্তিক কৃষক সংগঠনগুলোর লিডারদের নম্বরও থাকবে। বড় প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতারা সরাসরি এইসব ব্যবসায়ীদের কাছে ক্রয় আদেশ দিতে পারবেন। ম্যাপের মাধ্যমে নির্দিষ্ট জেলা-উপজেলা এমনকি বাজারভিত্তিক উৎপাদক ও ব্যবসায়ী খুঁজে পাওয়া যাবে। আইকন ক্লিক করে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।’

উপস্থাপনায় প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে আরও জানানো হয়, এটি এমনভাবে বানানো হয়েছে, যেন শুধুমাত্র মোবাইল ফোন নম্বর, ঠিকানা অথবা ইমেইল এড্রেস দিয়ে কৃষক, বিক্রেতা, ক্রেতা সকলেই একাউন্ট খুলতে পারবেন।

শুধু বিক্রয়ের জন্যই নয়, চাহিদার বিজ্ঞাপন দেয়া যাবে প্লাটফর্মে। ক্যাটাগরিভিত্তিক বিজ্ঞাপন ও এলাকা বা ব্যবসাভিত্তিক বিজ্ঞাপন দেয়া যাবে। ক্রেতা বা বিক্রেতা এখানে বিশেষ কোনো শর্তাবলী যুক্ত করতে পারবেন (যেমন মিনিমাম অর্ডার, কোয়ান্টিটি)।

আশিটি বিশেষায়িত ক্যাটাগরি থেকে ফসল বা পণ্য যুক্ত করতে পারবেন। প্লাটফর্মে শেয়ারবাজারের ‘টিকার’ এর মতো বিভিন্ন ফসলও কৃষিপণ্যের দৈনিক গড় বাজার দর দেখা যাবে। দরের উত্থান ও পতন দৈনিক ভিত্তিতে দেখানো হবে। বর্তমানে কৃষি বিপণন অধিদফতরের ডাটা এক্ষেত্রে আপডেট হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে আগত ডাটা একই সঙ্গে সন্নিবেশিত হবে।

কৃষি বিপণন অধিদফতর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নম্বর থাকছে প্লাটফর্মে। প্রত্যেকটি বিজ্ঞাপনের এলাকাভিত্তিক অটোমেটিকভাবে সেই এলাকার সঙ্গে সংযুক্ত কর্মকর্তাদের নম্বর প্লাটফর্ম প্রদর্শন করবে। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই প্রয়োজনে সাহায্য বা পরামর্শ নিতে পারবেন।

প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে যারা বারবার ব্যবহার করছেন তাদের ব্যবসা বা ট্রেডভিত্তিক ডাটাবেজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হবে ও প্রকাশিত হবে। যেন উভয়পক্ষই ভবিষ্যতে সেরা ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

পরিবহন খাতের সাথে যুক্ত স্টার্টআপসমূহ (যেমন- পাঠাও, ট্রাক লাগবে, সহজ, জাহাজী) সকলের যোগাযোগের সরাসরি মাধ্যম থাকছে প্লাটফর্মে। অচিরেই পরিবহন খরচ ক্যালকুলেটর যোগ হতে যাচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পরিবহন সেবা নিতে পারবেন ও দর ঠিক করতে পারবেন।

এক শপ, এক পে, এক দেশ ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম ‘ফুড ফর নেশনে’ যুক্ত থাকবে বলেও উপস্থাপনায় জানানো হয়।

দাম, বাজার পরিস্থিতি, পার্টনারশিপ পুরোটাই বাজারভিত্তিক উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সম্পন্ন করাই এর লক্ষ্য। স্টার্টআপ বাংলাদেশের ১২টি স্টার্টআপের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এছাড়া বাজারে শীর্ষস্থানীয় গ্রোসারি স্টার্টআপ, পরিবহন স্টার্টআপ, টেকনোলজি প্রোভাইডার, সরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুলোসহ সকলকে এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে একসঙ্গে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে।

স্টার্টআপ কমিউনিটির প্রায় ২৩টি কোম্পানি এখনই এর সঙ্গে যুক্ত আছে। সামনের দিনগুলোতে আরও প্ল্যাটফর্ম প্রতিনিয়ত এর সঙ্গে যুক্ত হবে। ধীরে ধীরে কৃষি নিয়ে কাজ করতে থাকা অন্যান্য স্টার্টআপ, এনজিও ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এর সঙ্গে যুক্ত হবে বলে আশা করা যায় বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আরএমএম/এনএফ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।