ওষুধ প্রশাসন ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দ্বন্দ্ব কোথায়?
কন্ট্রাক্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (সিআরও) মাধ্যমে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তের কিট পরীক্ষা করতে যত টাকা লাগবে, তা দেয়ার প্রস্তাব করেছে সুচিন্তা ফাউন্ডেশন। এমিনেন্স কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি সিআরও প্রতিষ্ঠানও বিনা পয়সায় কিট পরীক্ষা করে দেয়ার প্রস্তাব করেছে।
তবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বলছে, মধ্যস্বত্বভোগী সিআরও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা কিট পরীক্ষা করবে না। কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিট পরীক্ষা করাবে। যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠানে তারা কিট পরীক্ষা করবে, তাই সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের অর্থ এবং এমিনেস কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিনা পয়সায় পরীক্ষার সহযোগিতা কাজে লাগছে না। তবে তাদের এগিয়ে আসার এ মানসিকতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
এদিকে, বুধবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তের কিটের সক্ষমতা পরীক্ষা করতে চায় সিডিসি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) দুপুরে জাগো নিউজকে এসব তথ্য জানান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। স্বাভাবিকভাবেই তার কাছে প্রশ্ন, মধ্যস্বত্বভোগী সিআরও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কারণেই কী কিট পরীক্ষায় বিলম্ব?
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তের কিট যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিডিসির কাছে হস্তান্তর
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জবাব, দেশে আটটি সিআরও প্রতিষ্ঠান আছে। তারা সবাই বেসরকারি। সিআরও করে এমন আরেকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হলো আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। এরা সবাই হলো মিডল ম্যান বা মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান। তারা পরীক্ষা করতে বড় অঙ্কের অর্থ নেয়। মধ্যস্বত্বভোগী এসব প্রতিষ্ঠান দিয়ে কিট পরীক্ষা করতে বলছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর।
‘কেবল বেসরকারি সংস্থা দিয়ে কিট পরীক্ষা করব কেন? আমাদের সরকারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এত বড় সক্ষমতা আছে, তারাও করতে চাচ্ছে। তাদের দেয়া হচ্ছে না কেন? তাছাড়া সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), আর্মি প্যাথলজি বা শিশু হাসপাতাল করতে পারে। সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানের কিট পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। আমরা সরকারের এসব প্রতিষ্ঠান দিয়েই করাতে চাই। কিন্তু ওষুধ প্রশাসন তা দিচ্ছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করছে ওষুধ প্রশাসন।’
তার যুক্তি, ‘সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো কিট পরীক্ষা করলে তাদের সক্ষমতা, কার্যক্ষমতা বাড়বে। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দেশের নাম হবে। ওইসব সিআরও মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে উঠতে দিচ্ছে না। এসব কারণে আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানে করতে চেয়েছি।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তের কিট
‘একটা চিঠি দিতে হবে ওষুধ প্রশাসন থেকে। তারা আমাদের বলবে, ওমুক জায়গায় স্যাম্পল দিয়ে আসেন, আমরা দিয়ে আসব। আর উনারা (ওষুধ প্রশাসন) বলতেছে, নিয়ম মানতেছি না। ভাই, নিয়মটা কী মানতেছি না’— প্রশ্ন রাখেন ডা. জাফরুল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমি চিঠি লিখেছি। আমি বিএসএমএমইউকেও চিঠি লিখেছি, ওষুধ প্রশাসনকেও। কোনো জায়গায় যেতে আমাদের আপত্তি নাই। তবে আমি সিআরও-র মাধ্যমে যাব না।’
মধ্যস্বত্বভোগী এসব প্রতিষ্ঠানের সমস্যা কোথায় তা তুলে ধরে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘যত বেশি মধ্যস্বত্বভোগী বা মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে, তত বেশি অকারণে জটিলতা বাড়ে, জিনিসের দাম বাড়ে। আমরা সিআরও পদ্ধতির বিরুদ্ধে। এটা তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থবিরোধী। যেমন- কৃষক ধান উৎপাদন করে। আর ফড়িয়ারা ঢাকায় এনে তা বেশি দামে বিক্রি করে। যে ব্যবহারকারী, সেও ক্ষতিগ্রস্ত এবং যে উৎপাদন করছে, সেও ক্ষতিগ্রস্ত। লাভবান হলো মধ্যস্বত্বভোগী। সিআরও হলো একটা মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান। তারা বিভিন্নজনকে খুশি করে বিভিন্নভাবে। শেষপর্যায়ে খরচটা তো জনগণের ওপরই যায়।’
‘মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি আমাদের জীবনযাত্রায়। এ নিয়ম বদলানো দরকার। মানুষের স্বার্থবিরোধী নিয়ম আমি গ্রহণ করতে চাই না।’
সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের কিট পরীক্ষার টাকা দেয়ার বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘তারা কিট পরীক্ষার টাকা দিতে চায়। এটা তার (সুচিন্তা ফাউন্ডেশন) গুড ইনটেনশন (ভালো প্রবণতা)। তারা একটা ভালো কাজের অংশীদার হতে চেয়েছে, এজন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, ধন্যবাদ জানাই। সরকারি ফি আমিও দিতে পারব। তাই সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের অর্থটা আপাতত প্রয়োজন পড়ছে না, যেহেতু আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানে করাতে চাই। ফলে সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের অর্থটাও খরচ হচ্ছে না।’
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর
এমিনেন্সের বিষয়ে তিনি বলেন, “এমিনেন্স বলে একটা মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান আছে, যারা সিআরও করে। তারাও এখন বিনা পয়সায় করতে রাজি আছে। আমি জিজ্ঞাসা করেছি, তোমরা যে বিনা পয়সায় করবা, চলবা কী কইরা? তারা বলে, ‘আমাকে অন্য কেউ পয়সা দেবে।’ তাদেরও ধন্যবাদ। তবে আমি তাদের না করে দিয়েছি। আমার কথা হলো, কোনো মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানে যাব না।’
বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলেও (বিএমআরসি) কিট জমা দিয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এ বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বিএমআরসির কাছে জমা দিয়েছি। তারা বলেছে, পরীক্ষা করে খুব সত্বর তাদের মতামত দেবে।’
ক্ষোভের সঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এগুলো সফল হলে সরকার গ্রহণ করবে কি-না, সেটা সরকারের ওষুধ প্রশাসনের ব্যাপার। আমার কাজ আমি করে দিচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষ যদি নিজের স্বার্থ না বোঝে, আমি কী করব?’
‘মধ্যস্বত্বভোগী’ সিআরও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহর অভিযোগ প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘উনার (ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী) মনের মতো তো হবে না, আমাদের যে নিয়ম আছে, সেই নিয়ম অনুযায়ী করতে হবে। সিআরও-এর মাধ্যমেই তো করতে হবে।’
‘উনি বললেন যে, আইইডিসিআরে করবেন, কিন্তু সেখানে তিনি কীভাবে করবেন? সেখানে তো একটা প্রোটোকল ডেভেলপ করতে হবে, সেটা পাস করতে হবে, এ কাজগুলো কে করবে? এ কাজগুলো করার জন্য অ্যাসাইনড (দায়িত্বপ্রাপ্ত) প্রতিষ্ঠান লাগে, তা না হলে তো হয় না।’
এদিকে শুরু থেকেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র দাবি করে আসছে, তাদের তৈরি কিটের মাধ্যমে দ্রুত এবং স্বল্প খরচে করোনা শনাক্ত করা সম্ভব। গত ২৬ এপ্রিল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ‘কিট আসুক না আসুক, কাউকে ঘুষ দেবে না গণস্বাস্থ্য’— এমনটি উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যে কিট উদ্ভাবন করেছে, সেটা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর নেয়নি। তিনি সেসময় বলেন, ‘সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ব্যবসায়িক স্বার্থে জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করছে। তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে গণস্বাস্থ্যের কিট গ্রহণ করেনি। আমরা জনগণের স্বার্থে শুধু সরকারের মাধ্যমে পরীক্ষা করে কিটটি কার্যকর কি-না, তা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকারিভাবে প্রতি পদে পদে পায়ে শিকল দেয়ার চেষ্টা হয়েছে।’
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এমন অভিযোগের পরদিন (২৭ এপ্রিল) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তারা ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি দিলেন, এখন বলছেন সহযোগিতা করছি না?’
তিনি বলেন, ওনারা একটা টেস্ট ডেভেলপ করেছেন। আমাদের দিক থেকে, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দিক থেকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম এবং এখনও আছি। আমরা যে সহযোগিতা করেছি এর প্রমাণ আমি বলি। ওনাদেরই চিঠি। একটি চিঠি তুলে ধরে ডিজি বলেন, এটা গণস্বাস্থ্যের চিঠি। এখানে ওনারা লিখেছেন, ‘দেশে এই অস্বাভাবিক অবস্থা ও সার্বিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আপনারা দ্রুত আমাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ৭ এপ্রিল ফ্যাক্টরি ভিজিট করা এবং আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’ এই চিঠি তাদের।
আরও একটি চিঠি তুলে ধরে মহাপরিচালক বলেন, এটাও গণস্বাস্থ্যের চিঠি, আমাদের কাছ থেকে নিতে পারেন। ওখানে ওনারা বলেছেন, ‘কিট তৈরি ও বিপণন অনুমোদনের জন্য আপনারা আমাদের কারখানা সরেজমিনে যৌথভাবে পরিদর্শন করার নিমিত্তে একটি কমিটি গঠন করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। আপনাদের এই দ্রুত সিদ্ধান্তের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ এটি কিন্তু তাদের ২২ মার্চের চিঠি।
‘ওনারা তাহলে কীভাবে মনে রাখছেন। ওনারা যে বলছেন সহযোগিতা আমরা করছি না। তাহলে ওনারা কীভাবে বলতে পারেন, আমরা সহযোগিতা করছি না। আমরা তাদের বলেছি, এটা উদ্ভাবন হয়েছে, সেই উদ্ভাবন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যেভাবে এটিকে ভ্যালিডেটেড করতে হয়, সেটি করতে হবে’— বলেন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ডিজি।
গত ২৫ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ হস্তান্তর করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
কিট হস্তান্তরের সময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অভিযোগ করেন, আমন্ত্রণ জানানোর পরও মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার্স ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ছাড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত এ কিট গ্রহণের জন্য যায়নি সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রতিনিধি না থাকায় স্বাস্থ্য অধিদফতরকে কিট দেয়া যায়নি। আমাদের সিডিসি কনফার্ম করেছিল আসবে, একমাত্র তারাই এসেছে। সিডিসিকেই আমরা দিয়ে দেব। বাকিদের আমরা কালকে সরকারিভাবে প্রত্যেকের অফিসে পৌঁছে দেব। আমাদের দুঃখ, আপনাদের সামনে হস্তান্তর করতে পারছি না।’
পিডি/এমএআর/এমএস