৪৪ বছর পর হাসল কুষ্টিয়ার ৪ বীরাঙ্গনা
৭১ এ পাকহানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার এদেশের লাখো নারী। যেসব নারী আজও সামাজিক স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। বীরাঙ্গনা উপাধি ছাড়া রাষ্ট্রের কাছ থেকে এদের কপালে কিছুই জোটেনি। ঘৃণা-লাঞ্ছনা আর বঞ্চনায় ভরা এদের জীবন। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকারই বীরাঙ্গনাদের যোগ্য সম্মান দেয়নি। শুধু বীরাঙ্গনা শব্দের মধ্যেই দীর্ঘ ৪৪ বছর আটকে রয়েছেন লাল-সবুজের পতাকার জন্য সব হারানো এসব নারী। অথচ দেশ স্বাধীনের পেছনে এসব বীরাঙ্গনা নারীদের অবদান মুক্তিযোদ্ধাদের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। তবে অনেক দেরিতে হলেও দীর্ঘ ৪৪ বছর পর সেই বীরাঙ্গনা নারীদের স্বীকৃতি মিলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বীরাঙ্গনাদের মধ্যে ৪১ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
গত ১২ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সারা দেশের ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সেই সৌভাগ্যবান বীরাঙ্গনাদের চার জন হলেন, কুষ্টিয়ার এলেজান নেছা, দোলজান নেছা, মোমেনা খাতুন, মজিরন নেছা। যারা কিনা দু:সাহসিকতা দেখিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালতে গোলাম আযমদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আজ তাদের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস। চোখে আনন্দ অশ্রু। স্বামী সন্তানদের গর্বের শেষ নেই।
কুষ্টিয়ার চার বীরাঙ্গনার একজন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল কুমারখালী উপজেলার হাসিমপুর উত্তরপাড়া গ্রামের এলেজান নেছা। বয়স সত্তর ছুই ছুই। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে সমাজ তাকে দিয়েছে শুধু লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর ঘৃণা। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে অভাব অনটনের সাথে যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। শরীরের নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় শুধু একটু সম্মানের অপেক্ষা! কিন্তু সেই অপেক্ষার পালা কবে শেষ হবে ? এমন প্রশ্নের অবসান হয়েছে ক’দিন আগেই। গত ১২ অক্টোবর ছিল তাদের জীবনের আরো একটি ঐতিহাসিক দিন যেদিন সরকার তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
কেমন লাগছে জানতে চাইলে চোখের জল যেন ঠেকানো যাচ্ছিলনা। তবে এই জল কষ্টের নয়, আনন্দের। দীর্ঘ ৪৪ বছর পর স্বীকৃতি পাওয়ায় তাই জমিয়ে রাখা পানি ধরে রাখতে পারেননি তিনি। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া জীবনের শেষ সময়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ায়। আল্লাহ শেখের বেটিকে বাঁচিয়ে রাখুক।
এলেজান জানান, স্বামী সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। পেটের পীড়া, কানে অঝরে পানি পড়ে। নানা রোগ শোকে বাসা বেঁধেছে। নিরাময় হচ্ছেনা। স্বামীর হাই প্রেসার। তার শরীরও ভালো নেই। অভাবের তাড়নায় ছেলের লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। সহায় সম্বল বলতে কিছু নেই। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। আর অসবর সময়ে বাড়তি করেন তাঁতের কাজ। এতসব কষ্টের দিনে জীবনের শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি তাকে দারুণভাবে গৌরবান্বিত করেছে। আমার পরিবারে কোনো অভাব থাকবেনা, কেউ কোনো খারাপ কথা বলবেনা। আমি আজ মুক্তিযোদ্ধা। জীবনের শেষ দিনগুলো গৌরবের সাথে পার করতে পারবো।
স্ত্রীর এমন স্বীকৃতিতে দারুণ খুশি স্বামী আকবর আলী। মুক্তিযোদ্ধার স্বামী হিসেবে দারুণ লাগছে। আমার স্ত্রী সম্পর্কে আর কেউ বাজে কথা বলবেনা। স্ত্রীর এমন স্বীকৃতিতে স্বামী হিসেবে গর্বিত।
আর মায়ের এমন স্বীকৃতিতে কম খুশি নয় ছেলে তরিকুল। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এখন থেকে পরিচিত হব একি কম আনন্দের।
মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে খুঁশির অন্ত নেই একই এলাকার দুলজান নেছারও। স্বামীহারা অভাবের সংসারে সরকারের এমন স্বীকৃতি কি কম আনন্দের? স্বামী হারা দুলজানের এমন কষ্টের দিনে এমন সুসংবাদ আসবে ভাবতেও পারেননি কখনো। তবে দুখের পরে সুখ আসে এমন প্রবাদের কথা জানা ছিল তার। আর এর প্রমাণও মিলেছে জীবনের শেষ মুহূর্তে। মায়ের এমন স্বীকৃতে তাই খুশির অন্ত নেই মেয়ে সুমনা খাতুনের। হাসিনা সরকার তার মাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় আল্লার দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছেন তিনি। এখন মুক্তিযোদ্ধা মায়ের সন্তান এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি।
পাশের গ্রাম বানিয়া কান্দির আরেক বীরাঙ্গনা মোমেনা খাতুন। তিনি পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। তার কন্ঠেও একই উচ্চারণ। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর শেষ পর্যন্ত পেলাম মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। সারাটি জীবন আক্ষেপ নিয়ে থাকতে হবে ভেবেছিলাম। তবে জীবনের শেষ সময় যে এমন স্বীকৃতি পাবো ভাবতেও পারিনি কখনো। আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া। আল্লাহ যেন হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখে। একই উপজেলার মধুপুরের মজিরন নেছারও কি কম উচ্ছ্বাস। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে পরিবারে বইছে আনন্দের বন্যা।
তিনি বলেন, ৪৪ বছর আগেই যদি এই স্বীকৃতি পেতাম তাহলে এই সমাজের কাছে আমাদের আর এত লাঞ্ছনা-বঞ্চনা শুনতে হত না। অনেক দেরিতে হলেও সরকার যে শেষ পর্যন্ত তাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে তাতেই তিনি খুশি। তবে সরকারের কাছে তার দাবি শুধু ৪১ জনকে নয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্যাতিতা সব নারীকেই যেন তাদের মতো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়। এদিকে দু:সাহসিকতা দেখিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালতে গোলাম আযমদের বিরুদ্ধে সেদিন যারা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম কুষ্টিয়ার অন্য অপর দুজন বীরাঙ্গনা একই উপজেলার হাশিমপুর উত্তরপাড়া গ্রামের মাছুদা ও বংশীতলা গ্রামের রাবেয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় চরম মুষড়ে পড়েছেন। কেন তাদেরকে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলো তা তারা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। তাদের দাবি সরকার যেন অবিলম্বে তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেয়।
কুষ্টিয়ার এই চার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি জেলার ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল আলম টুকু। তিনি জানান, সব সরকারের কাছেই এই বীরাঙ্গনাদের যোগ্য মর্যাদার দাবিতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সব সময়ই স্বোচ্চার ছিলাম। কিন্তু বিগত কোনো সরকারই বীরাঙ্গনাদের এই স্বীকৃতি দেয়নি। তবে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে যে অবদান রাখলেন তার ঋণ কখনো শোধ হবার নয়।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট লালিম হক বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আমরা ৭১’এ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই যারা জীবন দিয়েছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা নয়। যারা বীরাঙ্গনা যারা নিজের দেহকে বিলীন করে দিয়ে সম্ভ্রমকে ধ্বংস করে দেশ স্বাধীনতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন আজ দেশের সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কারণ দেশ ও জাতির জন্য প্রাণ দেওয়া যেমন বলিদান নিজের চরিত্র, ঐশর্য এবং নিজের বেঁচে থাকার সম্ভ্রমটাকে জাতির জন্য দেশের জন্য ত্যাগ করাও একটি বিরাট উৎসর্গ। তাদেরকে আজ রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হয়েছে আমরা কৃতজ্ঞ, কৃতজ্ঞতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকেও।
দেরিতে হলেও সরকারের এমন স্বীকৃতিকে যুগান্তকারী হিসেবে দেখছেন ঘাতকদালাল নির্মূল কমিটি। কমিটির নেতা অসিৎসিংহ রায় মনে করেন, একমাত্র বর্তমান সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে কাজ করে। বীরাঙ্গণাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এই সরকার আরেকবার প্রমাণ করল শেখ হাসিনার সরকারই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার।
এমএএস/এমএস