হাওরাঞ্চলে ৩ বছরে ৬৭ খুন


প্রকাশিত: ০৫:১১ এএম, ১৪ অক্টোবর ২০১৫

শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চল। জলাশয়কে কেন্দ্র করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের মাঝে উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। গত ৩ বছরে জেলার ভাটি অঞ্চল বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ ও লাখাই উপজেলায় নানা কারণে খুন হয়েছে মোট ৬৭ জন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বানিয়াচং উপজেলাতে খুন হয়েছে মোট ৩৩ জন। ওই উপজেলার হাওরবেষ্টিত মন্দরী গ্রামেই শুধু গত ৫ বছরে খুন হয়েছে ৪ জন। এর মাঝে গত ঈদুল আযহার পর দিনই খুন হয়েছে দুইজন। বিভিন্ন সময় গ্রাম্য রাজনীতির শিকার হয়ে নিহতদের সবাই দিনমজুর কিংবা বর্গাচাষি। এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে গ্রাম্য রাজনীতিতে মেতে উঠে মাতব্বররা। চলে লাখ লাখ টাকার খেলা।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মাতব্বররা প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে কৌশলী অবস্থান নেন। সংঘর্ষ বাধিয়ে দিয়ে নিজের পক্ষের লোককে হত্যা করে থাকেন। কখনও আবার নিহত বা আহতদের পরিবারের কেউই মামলার বাদি হয় না। যার পক্ষের লোক মারা গেল তার পক্ষের মাতব্বর বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন। এ সকল ঘটনার মামলাগুলোতে আসামি করা হয় শ’ হিসেবে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা মাতব্বররা টাকা উপার্জনের কৌশল হিসেবে এমনটি করে থাকেন বলে জানা গেছে।

দু’পক্ষেরই উত্তেজনাপূর্ণ সংঘর্ষ হলেও মামলার এজাহার এমনভাবে লেখা হয়, যেন আহত বা স্বাক্ষীরা দাঁড়িয়ে দেখেছে কার উপর কে, কিভাবে, কি দিয়ে, কটি আঘাত করেছে। কার আঘাতে কে মারা গেল। এ অবস্থায় অনেক মামলায় স্বাক্ষী প্রমাণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। খালাস পেয়ে যায় আসামিরা। কখনও আবার সালিশে বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে তা নিষ্পত্তি হয়ে যায়। যার খুব সামান্যই পায় নিহতদের পরিবার বা আহতরা। মন্দরী গ্রামের সাম্প্রতিক ডাবল মার্ডারের বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। এ সময় বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এ সকল তথ্য।

এ সকল বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলে বানিয়াচং থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নির্মলেন্দু চক্রবর্তী জাগো নিউজকে জানান, এটি জেলার সবচেয়ে বড় থানা। এখানে ১৫টি ইউনিয়ন রয়েছে। যার বেশির ভাগই অত্যন্ত দুর্গম। হাওরবেষ্টিত হওয়ায় শুকনো মৌসুমে এসব ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে পৌঁছাতে পায়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবুও সময় মতো খবর পাওয়া গেলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, জেলার সবচেয়ে বেশি এবং বড় বড় জলাশয়গুলো এ উপজেলায় অবস্থিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলো দাঙ্গা প্রবণ এলাকা। সাধারণত জমি, সেচ, জলাশয় নিয়েই এখানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে থাকে। কারণ এগুলোতে অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত রয়েছে। যারা ঘটনার নায়ক থাকে তারা এলাকায় থাকে না। অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনার সময় নিজেরা উপস্থিতও থাকে না। মন্দরীর ঘটনায় নিহতদের পরিবারের কেউ মামলার বাদী হয়নি। এ ঘটনায় বাদী হয়েছেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শেখ সামছুল হক। বেলা সাড়ে ১১টায় যখন আমরা জেনেছি তার আগেই একজন খুন হয়ে গেছে।

Haor

জানতে চাইলে এক পক্ষের নেতা মন্দরী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মামলার বাদী শেখ সামছুল হক জাগো নিউজকে বলেন, যেহেতু আমার জলাশয় নিয়ে তারা মারা গেছে তাই আমি বাদী হয়েছি। আমি তাদের পরিবারগুলোকেও দেখাশুনা করছি।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হাওরবেষ্টিত দ্বীপতুল্য মন্দরী গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একেকটি পরিবারের কয়েকটি বাড়ি নিয়ে একটি মহল্লা। একটি মহল্লা থেকে আরেকটি মহল্লার দূরত্বও বেশ। চলতি মৌসুমে নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। সংঘর্ষ স্থলটি (বিরোধপূর্ণ জলাশয়ের কিনারা) গ্রামের এক প্রান্তে অবস্থিত। যেখানে শেষ প্রান্তের লোকদের ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতেও বেশ সময় লাগে।

গ্রামটিতে শেখ সামছুল হকের পক্ষের লোকজন বাড়িঘরে থাকলেও মজিদ খানের পক্ষের বাড়িঘরে পুরুষ বলতে কেউই নেই। যেন অনেকটাই নিরব, নিঃস্তব্দ গ্রামটি। আবার যারা বাড়িঘরে আছে তাদের মাঝেও উত্তেজনার কমতি নেই। নিহত দিনমজুর জয়নালের ঘরটি ছিল তালাবদ্ধ। তার ভাই আহত তজমুল মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তিনিও গুরুতর আহত। কথা বলতে পারছেন না।

তার দুই স্ত্রী সরফুন্নেছা ও রাবেয়া খাতুন জানান, জয়নাল অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাত। সংঘর্ষ চলাকালে বাড়ির সামনেই তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তারা কেন মামলার বাদি হননি জানতে চাইলে তারা বলেন, শেখ সামছুল হক তাদের চাচা শ্বশুর হন। তিনিই মামলা করেছেন। তিনিই তাদের দেখাশোনা করেন।

আরেক নিহত সাহাব উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, তিনি বিয়ে করেছিলেন মাত্র কয়েকমাস আগে। ঘটনার দিন তার স্ত্রী অরুনা আক্তার বাবার বাড়িতে ছিলেন। স্বামী হত্যার খবর পেয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি কান্না ছাড়া কোনো কথাই বলতে পারেননি।

নিহতের ভাই মোকাদ্দিছ মিয়া জানান, তিনি নিজেও এ ঘটনায় আহত হয়েছেন। সকাল ৯টায় সংঘর্ষ শুরু হয়। শেষ হয় বেলা ১১টার দিকে। তারা দুপুর ১টার দিকে সদর আধুনিক হাসপাতালে পৌঁছান। ডাক্তাররা তার ভাইকে সিলেট পাঠানোর কথা বললে বিকেল ৪টায় সিলেটে পাঠানো হয়।

প্রধান আসামি মজিদ খানের মা বিবি হাজেরা আক্তার বলেন, বিরোধপূর্ণ জমিটি সামছুল হকের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। এখানে আমাদেরও জায়গা আছে, অন্যদেরও আছে আবার সরকারেরও আছে। তাছাড়া ঘটনার দিন আমার ছেলেরা ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটে নিজেদের কর্মস্থলে অবস্থান করছিল। অথচ তাদের আসামি করেছে। এখন তার লোকজন আমাদের গালিগালাজ করে, হুমকি দেয়। শিশুদের ধরে নিয়ে যাবে, লুটপাট করবে।

আরেক অন্যতম আসামি ইকবাল হোসেনের বাবা রমিজ আলী জানান, তার ছেলে ইউপি নির্বাচনে সামছুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। তারা উভয়েই ফেল করেছে। এছাড়া গ্রামে তার অপকর্মের বিরুদ্ধে একমাত্র ইকবালই কথা বলতো। গ্রামের মানুষজনও তাকে বেশি মূল্যায়ন করে। এতে আক্রোশান্বিত হয়ে আগামী নির্বাচনে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে রাখতে মামলায় জড়ানো হয়েছে।

স্থানীয় মহিলা মেম্বার মাহমুদা খাতুন জানান, তার বাড়ি মন্দরী গ্রাম থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে জলিলপুর গ্রামে। তার স্বামী পল্লী চিকিৎসক সাকিরান লস্কর সাবেক মেম্বার ছিলেন। তখন চেয়ারম্যান ছিলেন সামছুল হক। তার একাধিক অনিয়মের ঘটনায় তখন তিনিসহ অন্য মেম্বাররা অনাস্থা দেন। তিনি বলেন, এর জের ধরেই আমার স্বামী ও সন্তানকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। অথচ আমরা ঘটনার কিছুই জানি না।

বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের ১০ মাসে এখন পর্যন্ত বানিয়াচং উপজেলায় ৩৩ জন, লাখাই উপজেলায় ২১ জন এবং আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় ১৩ জন খুন হন। বিভিন্ন কারণে এসব হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়ে থাকলেও বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডই হয়েছে সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি, জলাশয়, সেচ প্রকল্প দখল ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে। গ্রাম্য মাতব্বররা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য গরিব লোকদের নিয়ে নিজের দল ভারি করেন। কৌশলে তারা সামান্য অযুহাতেই দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টি করে থাকেন বলে জানা গেছে।

এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।