প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষিত, দুরবস্থায় পোলট্রি-ডেইরি সেক্টর
করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কার্যত লকডাউন দেশ। আর অবস্থা সৃষ্টির পর থেকেই ধস নেমেছে দেশের পোলট্রি ও ডেইরি সেক্টরে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি তার ভাষণে ও ভিডিও কনফারেন্সে এ শিল্পকে বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। এর আগে (২ এপ্রিল) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নিজেও প্রেস কনফারেন্স করে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন এ শিল্প রক্ষায়। পরে পোলট্রি ও ডেইরির বিপণন, পরিবহন ও বিক্রিতে অন্যান্য কাঁচামালের সঙ্গে তুলনা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। পোলট্রি মুরগি, ডিম ও বাচ্চা বিক্রি করতে পারছেন না খামারিরা। এদিকে ডেইরি মালিকরা পারছেন না দুধ বিক্রি করতে। এতে পথে বসার উপক্রম হয়েছে দেশের কয়েক হাজার খামারির।
দেশের বিভিন্ন স্থানে পোলট্রি ও ডেইরি খামারের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তাদের পণ্য বাজারজাত করার বিষয়ে মন্ত্রী জেলা প্রশাসক ও জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা খামারিরা খবরের কাগজে পড়েছেন এবং টেলিভিশনের খবরে দেখেছেন। কিন্তু মাঠে এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটাও পর্যাপ্ত দুধ কিনছে না। পাড়ায় পাড়ায় হকারি করে ১৫-২০টাকা লিটার দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। ৩২ টাকার মুরগির বাচ্চা এখন ৪-৫টাকা, এক কেজি মুরগির মাংসের উৎপাদন খরচ ১১০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০টাকায়, ৭ টাকা উৎপাদন খরচের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকায়। এদিকে মুরগির খাদ্য কিনতে হচ্ছে আবার বেশি দামে।
তারা বলছেন, আর কিছু দিন এই অবস্থা থাকলে মুরগি, ডিম ও দুধ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। ব্রয়লার মুরগির ব্যবসা যারা করেন তারা অনেকে ইতোমধ্যে চালান হারিয়ে বাড়িতে বসে আছেন। এদিকে হেচারির মালিকরা কম দামে বাচ্চা দেবে (৩২ টাকার বাচ্চা ৪-৫ টাকা) তবুও তারা ব্যবসা করতে রাজি হচ্ছেন না।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম পোলট্রি এবং ডেইরির আর যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মতে, করোনা সংকটকালীন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। তাই প্রাণিজ পুষ্টির উৎস দুধ, ডিম, মাছ ও মাংসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং এ সংক্রান্ত সংকট মোকাবিলায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে পোলট্রি-ডিম, একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য, দুগ্ধজাত পণ্য, অন্যান্য প্রাণী ও প্রাণিজাত পণ্য, মাছ, মাছের পোনা ও মৎস্য খাদ্য সরকার ঘোষিত ছুটিকালীন নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণন সচল রাখার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সব জেলা প্রশাসক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের ডেইরি খামারি ও দুগ্ধ খামারি পরিচালক আবদুস সামাদ ফকির জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি পদক্ষেপের কথা শুনেছি তবে মাঠ পর্যায়ে এখনো তার প্রতিফলন দেখছি না। মিল্ক ভিটা এখনো পুরো দুধ কিনছে না। অন্য কোনো কোম্পানি দুধ কিনতে আসছে না।
তিনি বলেন, সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে বা সাড়ে ৪ ভাগ হারে যে ঋণ দেয়ার কথা বলছে তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হলে খামারিরা খুশি হবে। এ ছাড়া আমরা যে পণ্য উৎপাদন করছি তা ঠিকমতো বাজারজাত করতে পারলে খামারিরা লাভবান হবে। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক দামে দুধ বিক্রি করতে পারছি না।
সবচেয়ে বেশি মুরগির-বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আফিল এগ্রো লিমিটেড প্রতিদিন এক লাখের বেশি বাচ্চা উৎপাদন করে। খামারটি যশোরে অবস্থিত। এ ফার্মের পরিচালক মাহবুব আলম লাবলুর কাছে ফোনে জানতে চাওয়া হয় কেমন আছেন? উত্তরে তিনি বলেন, খুব খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছি। গত ২০ দিনেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে লাবলু জাগো নিউজকে বলেন, ৩২ টাকার মুরগির বাচ্চা এখন ৪-৫ টাকা, ১১০ টাকা কেজি উৎপাদন খরচের মুরগির মাংস ৪৫-৫০ টাকা, ৭ টাকা উৎপাদন খরচের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকায়।
তিনি বলেন, সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। লোকজন দোকান খুলতে পারছেন না। গাড়ি চলাচলে পুলিশ বাধা দিচ্ছে। খামারিরা মুগির বাচ্চা কিনছেন না। ঢাকায় মুরগি পাঠাতে চাইলে গাড়ির ড্রাইভার রাজি হচ্ছেন না। রাস্তায় খেতে না পারা এবং পুলিশের নানা ধরনের হেনস্তায় ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চায় না। এ অবস্থায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে এই পোলট্রি শিল্পে। তিনি আশা করেন এ সংকট নিরসনে সরকার দ্রুত একটি উদ্যোগ নেবেন।
টাঙ্গাইলের পোলট্রি খামারি ও ডিলার মো. ফরহাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তার প্রতিফলন নেই। জেলা প্রশাসক ও জেলার প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো খবর নেয়নি। আমরা মুরগি ও ডিম বিক্রি করতে পারছি না। গরমে ডিম পচে যাচ্ছে। মুরগির বয়স পার হয়ে চর্বি জমে মারা যাচ্ছে। কোনো দোকানপাট খোলা নেই। সরকারের ঘোষণা আছে সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাঁচামালের দোকান খোলা থাকবে। তবে দোকানের সামনে কয়েকজনের ভিড় দেখলেই পুলিশ দৌড়ে এসে দোকান বন্ধ করে দেয়।
ফরহাদ বলেন, আমরা পোলট্রি ব্যবসায়ীরা মহা বিপদের মধ্যে আছি। যাদের মুরগির বাচ্চা ও খাবার বাকি দিয়েছি তারা মুরগির ডিম বিক্রি করতে পারছেন না, টাকাও পরিশোধ করতে পারছেন না। এবার পোলট্রি খামারিরা যেভাবে লস খাচ্ছে তাতে আর কেউ এ ব্যবসা করতে আসবে না। হাজার হাজার পোলট্রি খামারির কান্নার মূল্য কেউ দিচ্ছে না। সরকার শিগগিরই কোনো ব্যবস্থা না নিলে সেদিন বেশি দূরে নেই যেদিন মুরগি এবং ডিম বেশি দাম দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর বার্তা পাওয়ার পর আপনারা জেলা বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করেছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিদিনই কোনো না কোনো খামারিকে পাঠানো হচ্ছে । তাদের অফিস সব সময়ই তালা মারা থাকে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমে দায়িত্বরত ড. এস এম যোবায়দুল কবির (উপসচিব, মৎস্য ও পরিকল্পনা শাখা-২) জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে নির্দেশনা আছে তাতে আমাদের কার্যক্রম হচ্ছে মৎস্য ও প্রাণিজাত ফুড পরিবহনে কোনো সমস্যা যেন না হয়। যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে আমরা সেসব সমস্যার সমাধান করছি। ইতোমধ্যে আমরা বেশকিছু সমস্যার সমাধানও করেছি। কিন্তু খামারিরা দুধ বিক্রি করতে পারলো কিনা, মুরগি বিক্রি করতে পারলো কিনা এ সম্পর্কে আমরা কিছু বলতে পারব না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিল্ক ভিটা সম্পর্কেও আমরা কিছু বলতে পারব না। কারণ দুধ সংগ্রহে তাদের কি পরিমাণ লিমিট আছে তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে তিনি মনে করেন এ সময় খামারিদের কাছ থেকে মিল্ক ভিটার পর্যাপ্ত দুধ সংগ্রহ করা উচিত।
এফএইচএস/এমএফ/জেআইএম