পোকার দখলে আমন ক্ষেত, চাষির মাথায় হাত!


প্রকাশিত: ০৯:১৩ এএম, ১৩ অক্টোবর ২০১৫

নীলফামারীর অধিকাংশ আমন ক্ষেতে কারেন্ট পোকার প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। পোকার আক্রমণে ফসলহানির আশঙ্কায় কৃষকরা এখন দিশেহারা। আর এক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ নিরব ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, নীলফামারী জেলার ছয় উপজেলায় চলতি মৌসুমে এক লাখ ১১ হাজার ২২৩ হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে নীলফামারী সদরে ২৮ হাজার ৩০ হেক্টরে, ডিমলা উপজেলায় ১৯ হাজার ৪১৫ হেক্টরে, সৈয়দপুর উপজেলায় ৮ হাজার ৪০ হেক্টরে, ডোমার উপজেলায় ১৮ হাজার ৪৬০ হেক্টরে, কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ১৪ হাজার ৯৮৫ হেক্টরে ও জলঢাকা উপজেলায় ২৩ হাজার হেক্টরে। এতে চালের হিসেবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৬ হাজার ১৬৮ মেট্রিক টন।

সোমবার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠে যেখানে থাকবে সবুজের সমারোহ সেখানে মাঠের পর মাঠ ফসল বিবর্ণ হয়ে পাতা খঁড় কুটার সাদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা কিংবা উ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের (ব্লক সুপারভাইজার) উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই। মাঠ পর্যায়ে এসব কর্মকর্তাদের সাথে কৃষকদের দূরত্বের কারনে পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।

Nil-pic
চাষিদের অভিযোগ বাদামী গাছ ফড়িং (বিপিএইচ) বা কারেন্ট পোকা ছড়িয়ে পড়ছে আমন ক্ষেতে। ধানগাছে কাইচথোড় আসার পর পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। পোকার ডিম থেকে বেরিয়ে আসা বাদামী গাছ ফড়িংয়ের বাচ্চা ও পূর্ণবয়ষ্ক উভয় পোকা দলবদ্ধভাবে ধান গাছের গোড়ার দিকে অবস্থান করে গাছ থেকে রস খেয়ে ফেলছে। আর এ কারণে গাছ দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। তীব্র আক্রমণে ধান গাছ প্রথমে হলুদ ও পরে শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। যা দূর থেকে বাজ পড়ার মত দেখায়। প্রতিটি উপজেলায় কম বেশি এই পোকার আক্রমণ দেখা গেছে।

ডিমলা উপজেলার আমন ক্ষেতে ব্যাপকভাবে কারেন্ট পোকার আক্রমণ দেখা দেয়ায় কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে জেনেও কৃষি বিভাগ কর্মকর্তাদের পাশে না পাওয়ার অভিযোগ করেন কৃষকরা।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চলতি আমন মৌসুমে ১৯ হাজার ২৭৬ হেক্টর জমিতে চারা রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নিধারণ করা হলেও চারা রোপণ করা হয়েছে ১৯ হাজার ৪১৫ হেক্টর জমিতে। টানা বর্ষণ ও বন্যার কারণে ৩শ হেক্টর আমন ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেন, ডিমলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর উপজেলা সদরে অবস্থান না করার কারণে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত মাঠে থাকেন না। উক্ত কর্মকর্তা সপ্তাহের ২/৩ দিন বেলা ১১ টায় আসলেও দুপুর ২ টায় নীলফামারী চলে যান।

আমনের ক্ষেতে কারেন্ট পোকা, পাতা শুকানো রোগের কারণে কয়েক শত হেক্টর জমির ধান নষ্ট হচ্ছে। অথচ কৃষি বিভাগ বলছে আমন ক্ষেতের কোনো ক্ষতি হয়নি।

ডিমলা সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ তিতপাড়ার আবহাওয়া অফিস সংলগ্ন আমন ক্ষেতে দেখা যায়, পাতা হলুদ হয়ে আমন ধান গাছগুলো মরে যাচ্ছে। কৃষক জানায়, কারেন্ট পোকার কারণে ভিতরের অংশ শুকনো হয়ে গেছে। একাধিকবার কৃষি অফিসে খবর দেয়া হলেও কোনো কর্মকর্তা ফসল দেখতে আসেনি।

উক্ত এলাকার কৃষক আব্দুল মজিদের ছেলে বেলাল হোসেন (৩০) জানায়, তার ৩ বিঘা জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করলেও ধানের গাছ ভাল হলেও ২দিন থেকে ধানের গাছগুলো মরতে শুরু করেছে। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল কাফিকে সংবাদ দেয়া হলেও তিনি ব্যস্ত থাকার অভিযোগে ফসল দেখতে আসেনি। এরই মধ্যে ৩ বিঘা জমির মধ্যে ২ বিঘা জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

দক্ষিণ তিতপাড়া গ্রামের পাথরকুড়ার বছির উদ্দিনের ছেলে আজিজুল হক (৪০), মৃত মহির উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মালেকসহ (৪২) অনেকে জানায়, আমন ক্ষেত কারেন্ট পোকার কারণে পুড়ে যাচ্ছে আর কৃষি বিভাগের লোকজন অফিসে বসে আছেন।

জানা গেছে, ডিমলার ১০টি ইউনিয়নে বর্তমানে ১৭জন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। দুপুরে ডিমলা অফিসে গিয়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদসহ ৬ জন অফিসে বসে খোশগল্প করতে দেখা যায়। ফরিদ উদ্দিন বলেন, সাপ্তাহিক রিপোর্ট দেয়ার জন্য তিনি এখানে এসেছেন। এ সময় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল কাফিকে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানায় মাঠে মিটিং করিতেছি।

উপজেলা কৃষি অফিসের সফর সূচিতে উক্ত কর্মকর্তা দক্ষিণ তিতপাড়ার জয়নালের বাড়িতে কীটনাশক বিষয়ক মতবিনিময় সভা করার কথা লেখা থাকলেও সেখানে গিয়ে উক্ত কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল কাফি জানায়, রাতের ঘুম হারাম হয়েছে। কৃষকদের অত্যাচারের সব সময় মাঠে থাকতে হয়। কোথায় গিয়ে দেখা পাওয়া যাবে বলার পরে মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর বলেন, আমি ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের কৃষকদের আমন ক্ষেত পরিদর্শন করছি। আব্দুল কাফি প্রসঙ্গে বলেন, কাজের অবহেলার কারণে তাকে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের গদা গ্রামের ক্ষুদ্র চাষি শেখ সাদী রহমত উল্লাহ মাত্র ১৫ শতক জমিতে আমন ধান আবাদ করেছিলেন। তার পুরো ক্ষেত কারেন্ট পোকা বিনষ্ট করে দিয়েছে। তিনি মাথায় হাত রেখে বললেন, এই ব্লকের  উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার নাম লতিফ মিয়া শুনেছি, কিন্তু তার দেখা কোনদিন পাইনি। আমার ১৫ শতক ধান ক্ষেত পোকায় নষ্ট করে দিয়েছে। বাজার থেকে যে কীটনাশক পাওয়া যায় তাতে তেমন কোনো সুফল আসেনি।

মধ্যরাজিব গ্রামের কৃষক তারাজুল ইসলাম জানায়, ১০ বিঘা জমির ধানের মধ্যে অর্ধেক জমির ধান পোকায় আক্রান্ত। এ পর্যন্ত তিনবার পোকা তাড়াতে স্প্রে করেছি। কোনো কাজ হয়নি। এখন চতুর্থবার স্প্রে করছি।

এই উপজেলার বাহাগিলি ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পশ্চিমপাড়া গ্রামের কৃষক আলম হোসেন বলেন, তার ৪০ শতক জমির আমন ক্ষেত কারেন্ট পোকা আক্রমণ করেছে।

কিশোরগঞ্জ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা এনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, উপজেলায় কারেন্ট পোকার আক্রমণে ফসলের মাঠ পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বিএলবি নামের একটি রোগ এসেছে তাও বিচ্ছিন্নভাবে ব্রি- ১১ জাতের ধানে। এই রোগ সারাতে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ১০ শতক জমির জন্য ৬০ গ্রাম পটাশ ৩০ গ্রাম জিংক সালফার ও ৬০ গ্রাম কিউভিট পানির সঙ্গে মিশিয়ে ধান ক্ষেতে স্প্রে করলে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এ জন্য কৃষককদের সচেতন ও পরামর্শে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে এবং হচ্ছে।

নীলফামারী কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক গোলাম মো. ইদ্রিস এর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি কাজে খুবই ব্যস্ত বলে জানিয়ে ফোনের লাইন কেটে দেন।

এসএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।