গণতন্ত্র রক্ষার্থে কঠিন পথটাই বেছে নিতে হয়েছে
রাজশাহী-৬ আসন থেকে টানা দ্বিতীয়বারের মত নির্বাচিত সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মো. শাহরিয়ার আলম। যুক্ত আছেন পররাষ্ট্রের মত গুরত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। বিদেশি নাগরিক হত্যা, নির্বাচন, বৈশ্বিক নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। আজ (সোমবার) থাকছে শেষ পর্ব।
জাগো নিউজ : আপনি তো প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্কের সফর সঙ্গী ছিলেন। এই সফরের অর্জন নিয়ে কি বলবেন?
শাহরিয়ার আলম : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেয়াকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর। সফরের সফলতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার করেছেন। আমি মনে করি, এমন সময়ে এই সফর অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা করে প্রধানমন্ত্রী পুরো জাতিকে সম্মানিত করেছেন। বিশ্বনেতারা বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যার প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ এবং ‘আইসিটি’ পুরস্কার। এই সফরের বিশেষ দিক হচ্ছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা, উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশে বন্দরে বিনিয়োগে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছে। এ নিয়ে অন্য কোনো রাজনীতি গুরুত্ব পাচ্ছে কি-না?
শাহরিয়ার আলম : ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ দিনকে দিন গুরুত্ব পাচ্ছে। সিল্ক রুটের সঙ্গে সম্পৃক্ত, বিমসটেক, সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর অতিগুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যারা এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এখন সিদ্ধান্ত দেবেন।
জাগো নিউজ : সমুদ্র নিয়ে রাজনীতিও হয়। বঙ্গোপসাগরে চীন-জাপানের বিনিয়োগ ভারত কীভাবে নেবে?
শাহরিয়ার আলম : হ্যাঁ, এই ধরনের প্রকল্প নির্মাণে প্রতিবেশী দেশ কীভাবে নেবে সে দিকটা আমলে নিতে হবে। বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভারত তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, এই ধরনের বন্দর নির্মাণে যে আর্থিক এবং প্রযুক্তির দরকার, তা ভারতের নেই। তৃতীয় কোনো দেশ আগ্রহ প্রকাশ করলে ভারত তাতে যৌথভাবে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেই ভারত তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে ভারতেরও ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।
জাগো নিউজ : তিস্তা ইস্যু অন্তরালে পড়ে যাচ্ছে। কোনো অগ্রগতি আছে কি-না?
শাহরিয়ার আলম : তিস্তা ইস্যুর মতো সীমান্ত ইস্যু নিয়েও জটিলতা ছিল। সীমান্ত চুক্তি যেহেতু বাস্তবায়ন হয়েছে, সেহেতু তিস্তা ইস্যু নিয়েও জটিলতা কেটে যাবে। আমরা যতটুকু জানি, পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এ ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। বিষয়টি অনেকটাই চূড়ান্ত। ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মিটিয়ে ফেললেই তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হবে। আমরা এ নিয়ে শতভাগ আশাবাদী।
জাগো নিউজ : জেএসপি (শুল্কমুক্ত) সুবিধা প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে পোশাক শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন?
শাহরিয়ার আলম : জেএসপি সুবিধা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কার্যত আড়াই বছর আগেই প্রত্যাহার করেছে। রানা প্লাজার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তারা এমন সিদ্ধান্ত নেয়। রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। নিজেদের উপলব্ধির কারণেই হোক আর বিদেশি পরামর্শেই হোক পোশাক শিল্প নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হয়েছে। ওই সময় যে সিদ্ধান্ত হয়, তার প্রায় ৯৮ ভাগই পূর্ণ হয়েছে। কারখানা পরিদর্শন, শ্রম আইন বাস্তবায়ন নিয়ে সবাই সন্তুষ্ট।
জাগো নিউজ : তাহলে জেএসপি বাতিল হলো কেন?
শাহরিয়ার আলম : এটি খুবই দুঃখজনক। আমি নিজেও পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আমি নিজেও অবাক হয়েছিলাম যে, এত অল্প সময়ে পূরণ করা যাবে কি-না। উচ্চাবিলাসী হলেও আমরা পেরেছি। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শতকরা মাত্র ২ ভাগ অপূর্ণ থাকায় যুক্তরাষ্ট্র এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আমাদের অবাক করেছে। এর চেয়ে বেশি অবাক করেছে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ওয়াশিংটন পোস্টে কলাম লেখা নিয়ে। তিনিই জেএসপি সুবিধা বাতিলের অনুরোধ করেন। জেএসপি সুবিধা বাতিলে বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করেছে।
জাগো নিউজ : এই প্রশ্নে সরকার ব্যর্থ কি-না? সরকারের লবিস্টও কাজ করতে পারতো?
শাহরিয়ার আলম : আমরা কাজে বিশ্বাসী। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরিপ্রেক্ষিতে যে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলাম, তা বাস্তবায়নে আমরা অবিচল। এখানে কৃত্রিমতার আশ্রয় নিয়ে আমরা কারো অনুগ্রহ পেতে চাই না। রক্ত পানি করা শ্রম দিয়ে পোশাক শিল্প এগিয়ে নেবো। তৃতীয় কোনো পক্ষকে অথবা কোনো রাজনৈতিক ইস্যুকে ব্যবহার করে এক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা নেয়ার দরকার আছে বলে মনে করি না। ষড়যন্ত্র এমনিতেই কেটে যাবে।
জাগো নিউজ : দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এই উদ্বেগ আপনাদের কতটুকু নাড়া দিচ্ছে?
শাহরিয়ার আলম : আপনাকে সময় বাস্তবতা মূল্যায়ন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু এই সীমিত ক্ষমতা দিয়েই মানবতাবিরোধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র, বিএনপির ধ্বংসাত্মক আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড মোকাবেলা করতে হয়েছে। এটি একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। এর মধ্য দিয়ে কিছু অভিযোগও উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। তবে এসব বিষয়ে সরকার অবগত। গত কয়েক বছরে প্রায় ছয়শ র্যাব সদস্যকে বিভিন্নভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে। উন্নয়ন, গণতন্ত্র রক্ষার্থে আমাদের কঠিন পথটাই বেছে নিতে হয়েছে। অনেকেই মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে কথা বলছেন। ওইসব দেশের চেয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অনেক সুসংহত।
জাগো নিউজ : অনেকেই তো বলছেন- সরকার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের পথেই হাঁটতে চাইছে?
শাহরিয়ার আলম : আপনি বলুন তো, কোন সূচকে বাংলাদেশ সে পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে?
জাগো নিউজ : ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের হালচাল সেটাই প্রমাণ করে বলে অনেকে মত দিচ্ছেন?
শাহরিয়ার আলম : দেশে উন্নয়ন বেশি হচ্ছে বলেই অনেকে এভাবে বিশ্লেষণ করছেন।
জাগো নিউজ : তার মানে উন্নয়নের কারণে গণতন্ত্র আড়ালে পড়ে যাচ্ছে?
শাহরিয়ার আলম : বিএনপি নির্বাচনে আসেনি বলে আপনি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এক পয়েন্ট কম দিতেই পারেন। কিন্তু ৫ জানুয়ারির পর দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে তাতে আপনি কত পয়েন্ট যোগ করবেন। বিএনপি নির্বাচনে আসেনি বলেই গণতন্ত্র নিপাত যায়নি। বরং বিএনপি রাজনীতি থেকে সরে যাওয়াই ভালো। তারা পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে রাজনীতি করলে সবাই স্বাগত জানাবে।
জাগো নিউজ : এটি জনগণের মূল্যায়নের ব্যাপার নয়কি?
শাহরিয়ার আলম : জনগণ মূল্যায়ন করেই বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেকেই জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে বিবেচনা করছে অথচ বিএনপি তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া। বাংলাদেশের জনগণের হয়ে বিশ্ববাসীও এখন কথা বলছে। বিএনপি জামায়াতকে পরিত্যাগ করেও পরিবর্তনের রাজনীতি করতে পারে। আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করুক।
জাগো নিউজ : জনশক্তি রফতানিতে সরকারের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না?
শাহরিয়ার আলম : ২০০৯ সালে ওমানে বাংলাদেশি শ্রমিক ছিল প্রায় ৭৫ হাজার। এখন সেখানে শ্রমিক রয়েছে প্রায় ৫ লাখ। সৌদি আরবে আকামা পরিবর্তন হচ্ছে। শ্রমিক যেতে শুরু করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত আরো শ্রমিক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। মালয়েশিয়ায় বড় বাজার তৈরি হচ্ছে। এই কয়টি রাষ্ট্রই তো আমাদের কাছে জনশক্তি রফতানির মানদণ্ড। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার বেসরকারি সেক্টরকেও অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত বলে মনে করি।
জাগো নিউজ : মালয়েশিয়ায় সরকার তো জি টু জি পদ্ধতিতে শ্রমিক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পিছিয়ে আসল কি-না?
শাহরিয়ার আলম : জি টু জি ভালো সিদ্ধান্ত ছিল -এটি অস্বীকার করছি না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের মঙ্গলের জন্য সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করতে হয়। একে পিছিয়ে আসা বলা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে সরকারেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই কারণেই বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করলে সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করছি।
জাগো নিউজ : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহরিয়ার আলম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
এএসএস/জেডএইচ/আরএস/এমএস