‘আমি আমার সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি’
চারিদিকে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। প্রাণঘাতী এ ভাইরাস ইতোমধ্যে সারাবিশ্বে পাঁচ হাজার ৩০০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে দেড় লাখ। বাংলাদেশেও এর প্রভাব দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পাঁচ রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বাকি তিনজনের অবস্থাও ভালো। দ্রুত তারা বাড়ি ফিরবেন বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া সারাদেশে হোম কোয়ারেন্টাইনে (বিশেষ ব্যবস্থায় আলাদা বসবাস) আছেন দুই হাজার ৩১৪ জন। যাদের অধিকাংশই বিদেশফেরত। রোববার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
সার্বিক পরিস্থিতি যখন এমনই তখন সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো (স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়) বন্ধের দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। পক্ষে-বিপক্ষেও মতামত আসছে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহর নিয়ে বিশেষ আতঙ্কে আছেন সবাই। কারণ খুবই ছোঁয়াচে এ ভাইরাস যদি কোনোভাবে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এটি মহামাহি হিসেবে দেখা দিতে পারে বসবাসের অনুপযুক্ত হিসেবে বারবার নাম আসা এই মহানগরীতে।
দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সর্বিক নিরাপত্তায় দিকনির্দেশনামূলক ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে আসছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হবে কিনা— সে বিষয়ে দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না এ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। বারবার তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছেন। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তেমন পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি।
রোববার (১৫ মার্চ) সচিবালয়ে ১৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ‘জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বলছেন কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্যাদারিং হয়, সে বিষয়ে আপনারা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন’- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবরা ছিলেন। তাদের আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ড ওয়াশের ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আরেকটু বলেছি, আজ স্কুল ছুটি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা যে টেবিল-চেয়ার ব্যবহার করে সেগুলো যেন মুছে পরিষ্কার রাখা হয়। যাতে সেগুলো জীবাণুমুক্ত থাকে।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুপারিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন করছে না- এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে ক্লোজ ডোর আলোচনা হয়েছে। আপনারা অবজার্ভ করেন। এ সিদ্ধান্ত তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করবে। নিরাপত্তাজনিত যা যা বিষয় রয়েছে আমরা আজও তাদের অবহিত করেছি।’
‘আপনারা সভা-সমাবেশ এমনকি মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে নিরুৎসাহিত করছেন কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখছেন’- এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে আমরা বলছি না, আমরা সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বলছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না খোলা রাখবে, সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিষয়। আমাদের পরামর্শ যতটুকু যা দেয়ার সেটা আমরা দিয়েছি। এটুকু আপনারা আস্থায় রাখেন।’
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল করোনার বিষয়ে ‘সরকার সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আছে’ বলে মন্তব্য করেন। রোববার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘করোনাভাইরাস, COVID-19 এর সংক্রমণ ঝুঁকি নিয়ে সরকার সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ঝুঁকি বিশ্লেষণের একটি অংশ। প্রতিনিয়ত অবস্থা বিশ্লেষণ হচ্ছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েই এগোচ্ছি।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বিশেষজ্ঞগণের মতামত নিয়ে মন্ত্রণালয় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে, তবে সেটি হবে সেই ধরনের পরিস্থিতি এবং বিশেষজ্ঞগণের যথাযথ মতামতের মাধ্যমে।’
শিক্ষা উপমন্ত্রী আরও বলেন, ‘শহরাঞ্চল, গ্রামাঞ্চল— একেক জায়গায় সংক্রমণ ঝুঁকি একেক ধরনের হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা সংক্রমণ ঝুঁকি নিয়ে আমাদের উপদেশ দিচ্ছেন, আমরা যৌথ আলোচনা করে সেভাবেই এগোচ্ছি। সরকারের কোনো সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের একক সিদ্ধান্তে রোগ সংক্রমণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা হয় না। সবার প্রতি আহ্বান, সরকারের সিদ্ধান্তগুলোর ওপরে চোখ রাখুন এবং তা মেনে চলুন।’
শিক্ষা উপমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এক ঘণ্টার মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে ৩০২টি বক্তব্য আসে। সেখানে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী উল্লেখ করেন, ‘ঢাকা শহর এমনিতেই ঘনবসতিপূর্ণ, আর ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে ৯ বছর অবধি ঝুঁকি কম, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা!!! দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা ঢাকা শহরের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ে। তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কি আপনাদের নেই??? একজন শিক্ষার্থী মারা গেলে তখন কি টনক নড়বে??????’
অপর এক ব্যবহারকারী উল্লেখ করেন, ‘স্যার, মহামারি হওয়ার আগে দয়া করে ব্যবস্থা নিন।কারণ যে সব দেশে কোরোনা মহামারি রূপ নিয়েছে, সেসব দেশ আমাদের দেশের চাইতে উন্নত।’ তার এ বক্তব্যে সহমত জানিয়েছেন দুজন।
ফেসবুক ব্যবহারকারী এক অভিভাবক মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখেন, ‘বুঝলাম আপনারা বিশেষজ্ঞের মতামতের ওপর নির্ভর করছেন। তা যেন ১৭ তারিখের ওপর নির্ভর করে না হয়। কারণ আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা তো আপনাদের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকারের সিদ্ধান্ত সরকার নিক। আমি আমার সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। বাকিটা আল্লাহ্তালার ওপর ভরসা রাখলাম।’
অন্যদিকে মন্ত্রীর যুক্তির সঙ্গে সহমত পোষণ করে একজন লেখেন, ‘আমরা অতি সহজেই অধৈর্য হয়ে পড়ি। আর নিজেরা সকলেই বিশেষজ্ঞ হয়ে যাই। সরকারের দায়িত্ব হল সবচেয়ে বেশি। সরকার বোঝে কখন কী করতে হবে। এই জিনিসটি অনেকে বুঝতে চায় না।’
এমএআর/জেআইএম