রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করে যাবো : সারোয়ার আলম

আদনান রহমান
আদনান রহমান আদনান রহমান , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:১৮ এএম, ১৩ মার্চ ২০২০

সারোয়ার আলম। র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ পদটিতে থাকা কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা আগে কখনো ছিল না। তবে একের পর এক জনবান্ধব অভিযানে নিজেকে সবার কাছে তুলে ধরেছেন সারোয়ার আলম। সর্বশেষ করোনা ভাইরাসে বাংলাদেশে তিনজন আক্রান্ত হওয়ার পর ঢাকার দোকান ও ফার্মেসিতে স্টক শেষ হয়ে যায় মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজারের। বিক্রি হচ্ছিল ৪-৫ গুণ বেশি দামে। জনগণের প্রতি এ অন্যায় বন্ধে মঙ্গলবার মিটফোর্ডে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। পরদিন বুধবার মধ্যরাতেও অভিযান চালান তিনি। আটক করেন পাঁচ কোটি টাকার নিম্নমানের মাস্ক, মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধ।

তবে আলোচিত অভিযানের পাশাপাশি একবার হাইকোর্টের তলবের কারণে আলোচনায় আসেন এ ম্যাজিস্ট্রেট। সম্প্রতি তার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা কেড়ে নিতে দায়ের করা রিটে আবারও আলোচিত হন তিনি। ভ্রাম্যমাণ আদালতে এক ব্যক্তিকে দেয়া দণ্ডাদেশের চারমাস পার হলেও আদেশের প্রত্যয়িত অনুলিপি না পাওয়ার প্রেক্ষাপটে করা এক রিটে ১ ডিসেম্বর তাকে হাইকোর্টে তলব করা হয়। সেখান থেকে নিস্তার পাওয়ার পর গত বুধবার (১১ মার্চ) ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে তার (মোট তিনজন) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা (ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা) বাতিলের নির্দেশনার আর্জি জানিয়ে একটি সম্পূরক রিট আবেদন করা হয় হাইকোর্টে।

রিটের পরেই সরব হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সারোয়ার আলমের বিরুদ্ধে এমন রিটকে অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত বলে উল্লেখ করছেন তারা।

তবে এসবের মধ্যেও দমে যাননি সারোয়ার আলম। একের পর এক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। বুধবার মিটফোর্ডে রাতভর অভিযানের পর বৃহস্পতিবার সকালে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় তার।

সারোয়ার আলম বলেন, ‘যাই হোক, আমি আমার কাজ, আমার অভিযান বন্ধ রাখবো না। আমি যা করি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মানুষের জন্যই করি। রাষ্ট্রের কল্যাণে আমি এই কাজ করেই যাবো।’

সারোয়ার আলমের আলোচিত অভিযান

ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম প্রথম আলোচনায় আসেন ২০১৪ সালে। ফার্মগেটে ওভার ব্রিজ বাদ দিয়ে যারা সড়কে রাস্তা পারাপার হচ্ছিলেন তাদের নামমাত্র জরিমানা করে সচেতন করেছিলেন তিনি।

তার আলোচিত অভিযানের মধ্যে অন্যতম ছিল ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ফকিরাপুল ক্যাসিনোতে অভিযান। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদে অভিযান চালান তিনি। এ সময় ১৪২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। উদ্ধার করা হয় ক্যাসিনো থেকে উপার্জিত অবৈধ ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা।

২১ সেপ্টেম্বর নিকেতনে যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের অফিসে অভিযানে যায় র‍্যাব। সেখানেও ছিলেন সারোয়ার আলম। অভিযানে তার কার্যালয়ে তল্লাশী করে অবৈধভাবে উপার্জিত নগদ এক কোটি ৮০ লাখ, ২০০ কোটি টাকার এফডিআর, বিদেশি ডলার, মদ ও অস্ত্র উদ্ধার করেন তিনি।

১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার হাতিরপুলে ইউকে ও আমেরিকার বিভিন্ন কোম্পানির নকল করে বাংলাদেশে উৎপাদনের কারখানায় হানা দেন সাওয়ার আলম। হাতেনাতে ধরে সিলভান ট্রেডিং কো এবং টোটাল ফার্মাকে ৪০ লাখের জরিমানা ও দুইজনকে জেল দেন তিনি।

কুকুর ও পশুর মেয়াদউত্তীর্ণ ভ্যাকসিন

২৭ আগস্ট ফকিরাপুলের একটি ভবনে গিয়ে কুকুরসহ অন্যান্য পশুর মেয়াদউত্তীর্ণ ভ্যাকসিন বিক্রির চিত্র ধরা পড়ে। অভিযানকালে দেখেন, ২০১২ সালে মেয়াদউত্তীর্ণ হওয়া জলাতঙ্ক, বার্ড ফ্লুর ভ্যাকসিন ২০১৯ সালে কুকুরকে দেয়ার অভিনব প্রতারণার চিত্র। সব যাচাই বাছাই করে অ্যাডভানস অ্যানিমেল সায়েন্স কোং লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের ছয়জনকে জেল ও ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি। জব্দ করেন আরও ১০ কোটি টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ।

ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং
ঢাকায় যখন কিশোর অপরাধী ও গ্যাংয়ের দ্বারা হত্যাকাণ্ড, চুরি-ছিনতাই বেড়ে যায় তখন তাদের শনাক্তে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। ৩১ জুলাই গ্যাং, ছিনতাই, মাদকসহ নানাবিধ অপরাধে রাজধানীর শ্যামলী, শিশুমেলা, কলেজগেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৯ কিশোরকে আটক করে ছয় মাসের জন্য কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠান তিনি।

পশুর হাটে হানা

৯ আগস্ট গাবতলীর কোরবানির পশুর হাটে হানা দেন সারোয়ার আলম। হাতেনাতে ধরেন একজন পশু চিকিৎসককে। ওই চিকিৎসক গরুকে মোটাতাজাকরন স্টেরয়েড ইনজেকশন দিচ্ছিলেন। ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে।

দুধ ভেজাল

৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে বারো আউলিয়া ডেইরি মিল্ক অ্যান্ড ফুড লিমিটেডে অভিযান চালান। অভিযানে দেখেন ১০০ লিটার দুধের সঙ্গে পানি, স্কিম মিল্ক পাউডার এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে ২৮০০ লিটার পাস্তুরিত দুধ তৈরির চিত্র। প্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ ১২ জনকে কারাদণ্ড এবং ৫৮ লাখ টাকা জরিমানা করে ফ্যাক্টরি সিলগালা করেন তিনি।

jagonews24

ডেঙ্গু পরীক্ষায় সরকারি ফি

গত জুলাইয়ে সারাদেশ যখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত তখন হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু ও সিবিসি পরীক্ষায় মর্জিমতো ফি আদায় শুরু হয়। সংবেদনশীল এ বিষয়ে অভিযান শুরু করেন সারোয়ার। ৩১ জুলাই ডেঙ্গু পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেয়া এবং টেস্ট না করে প্যাথলজিক্যল রিপোর্ট দেয়ায় পল্টন এবং ফকিরাপুল এলাকায় চারটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঁচজনকে জেল, ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করে দুই প্রতিষ্ঠান সিলগালা করেন।

উত্তরার নামিদামি হাসপাতালে অভিযান

গত ২৯ জুলাই উত্তরার ক্রিসেন্ট, আরএমসি এবং লুবনা হাসপাতালে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। গিয়ে দেখেন টেস্ট না করেই দেয়া হয় মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ও কালচার টেস্ট রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে হাসপাতালে। রিপোর্টের ফাঁকা পাতায় অগ্রিম স্বাক্ষর দেয়া। ভেতরে ৩৪ টাকা ৫০ পয়সার পেথেডিন বিক্রি হচ্ছিল ৩৫০ টাকায়, চার টাকার ওষুধ ১০০ টাকায়। ল্যাব আর অপারেশন থিয়েটারে পাওয়া যায় মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট এবং সার্জিক্যাল সামগ্রী। এসব কারণে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে ১৭ লাখ, লুবনা হাসপাতালকে ২০ লাখ এবং আরএমসি হাসপাতালকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেন।

২৫ জুলাই ধোলাইপারে কিউর জেনারেল হাসপাতালে অপারেশন করার সময় এইচএসসি পাস দুই ভুয়া ডাক্তারকে আটক করেন তিনি।

হজের টিকিটে জালিয়াতি

সিন্ডিকেন্ট করে সৌদি এয়ারলাইন্সের টিকিট কিনে হজযাত্রীদের কাছ থেকে বেশি মূল্যে বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন তিনি। মেয়াদউত্তীর্ণ কসমেটিকস বিক্রির জন্য গুলশানের পার্সোনা বিউটি পার্লার ও ফারজানা শাকিল বিউটি পার্লারকে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করেন।

২৭ মে গরুর মাংসে রঙ ব্যবহারের জন্য নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে অভিযানে গিয়ে জেল জরিমানা করেন তিনি। বিজিবির সীমান্ত স্কয়ারের ফুডকোর্টের চারদিকে র্যাব সদস্য দ্বারা কর্ডন করে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। গিয়ে দেখেন কাপড়ে ব্যাবহার্য রং, আর শত সহস্র তেলাপোকা। জেল জরিমানা করেন তাদের।

নকল কসমেটিকসের বিরুদ্ধে চকবাজার, কেরানীগঞ্জ ও ডেমরা এলাকায় কমপক্ষে ১২টি অভিযান চালান তিনি।

বাদামতলী ও কারওয়ান বাজারেও একাধিক অভিযান চালান তিনি। এ সময় কাঁচা আমকে হলুদ করে বিক্রি এবং মেয়াদউত্তীর্ণ খেজুর বিক্রির চিত্র ধরা পড়ে।

চাঁদাবাজ হাতি

মে মাসে কারওয়ান বাজারে একটি অভিযান চালানোর সময় সড়কে গাড়ির ঠেকিয়ে, মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজির চিত্র চোখে পড়ে সারোয়ার আলমের। তখনই দুই হাতি ও মাহুতকে থামার নির্দেশ দেন তিনি। তবে মাহুৎ না থেমে দৌঁড়াতে থাকেন, পেছনে দৌঁড়েছেন তিনিও। অবশেষে হাতিরঝিলে গিয়ে আটকান তাদের। দুইজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।

পুরান ঢাকার কেমিক্যাল

গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে কেমিক্যাল বিস্ফোরণে পুরান ঢাকায় আগুন লাগার পর থেকে একের পর এক ক্ষতিকারক কেমিক্যাল সরানোর অভিযান চালান তিনি।

অ্যাপোলো, ইউনাইটেড, পপুলারসহ নামিদামি হাসপাতালে অভিযান

২০১৮ এবং ২০১৯ সালজুড়েই বড় বড় হাসপাতালের নজরদারি অভিযান চালান সারোয়ার আলম। অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট (রাসায়নিক উপাদান) ব্যবহার ও অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রির অভিযোগে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালকে ২০ লাখ টাকা, অ্যাপোলো হাসপাতালকে পাঁচ লাখ ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন।

এছাড়াও অভিযান চালিয়ে একই অভিযোগে পান্থপথের বিআরবি হসপিটাল, শমরিতা হাসপাতাল ও বাংলাদেশ স্পাইন হাসপাতালকে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করেন। নানান অনিয়মের অভিযোগে নগরীর চট্টগ্রামের ম্যাক্স হসপিটালকেও ১০ লাখের টাকা জরিমানা করেন তিনি।

সারোয়ার আলমের এমন সাফল্যের জন্য ২০১৯ সালের ১২ মে তার মাকে ‘গরবিনী মা’ পদক পরিয়ে দেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

এআর/এএইচ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।