ঢাকার সিটি নির্বাচনে বিজয়ীদের ৮০ ভাগের বেশি ব্যবসায়ী
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের জয়জয়কার। দুই সিটির বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে ৮০ শতাংশের (৮০.৭৮) বেশি বিজয়ী ব্যবসায়ী।
সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন-২০২০: বিজয়ীদের তথ্য বিশ্লেষণ ও নির্বাচন মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এ সময় সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনে সম্পদশালীরা বেশি হারে নির্বাচিত হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে স্বল্প শিক্ষিতের সংখ্যা বিরাট। এগুলো আমাদের রাজনীতির জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। বস্তুত আমাদের যেটা হচ্ছে, রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণ। যার ফলে ব্যবসা ও রাজনীতি, কোনোটাই ভালো চলছে না। এটা একটা অশনিসংকেত আমাদের জন্য সৃষ্টি করছে।’
প্রতিবেদনটি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, উত্তর সিটিতে ব্যবসা পেশার দিক থেকে দলগতভাবে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। উত্তরের সব জনপ্রতিনিধিদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, উত্তরের ৭৩ বিজয়ীর মধ্যে ৮৬ দশমিক ৩০ শতাংশ (৬৩ জন) ব্যবসায়ী। ২০১৫ সালে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর হার ছিল ৬৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালের তুলনায় ব্যবসায়ীদের নির্বাচিত হওয়ার হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের যুক্ত হওয়ার প্রবণতাই কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে না, প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় নির্বাচিত হওয়ার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবণতাকে নির্বাচনে অর্থবিত্তের প্রভাবের প্রতিফলন বলেই মনে করা যেতে পারে। আমরা আগেই বলেছি, এই প্রবণতা জনপ্রতিনিধিদের জনসেবামূলক ভূমিকার পরিবর্তে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিমূলক প্রবণতার প্রসার ঘটাতে পারে। এটা বিরাজনীতিকরণের ধারা শক্তিশালী হওয়ারও একটা লক্ষণ। আসলে রাজনীতিই ধীরে ধীরে ব্যবসায় পরিণত হচ্ছে কি না, এ প্রশ্ন করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।’
এ দিকে ঢাকা দক্ষিণের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ব্যবসা পেশার দিক থেকে দলগতভাবে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগের বিজয়ীরা। দক্ষিণের ১০১ জন বিজয়ীর মধ্যে ৭৫ দশমিক ২৫ ভাগ (৭৬ জন) ব্যবসায়ী। ২০১৫ সালে বিজয়ীদের মধ্যে ব্যবসায়ীর হার ছিল ৮০ দশমিক ২৬ ভাগ। অর্থাৎ, পেশার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় ব্যবসায়ীদের নির্বাচিত হওয়ার হার বেশি হলেও অতীতের (২০১৫ সাল) তুলনায় কমেছে। তার পরেও ঢাকা দক্ষিণের নির্বাচিতদের তিন চতুর্থাংশই ব্যবসায়ী।
ঢাকা উত্তর সিটিতে বিজয়ীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার দিক থেকে দলগতভাবে আওয়ামী লীগ এবং স্বল্প শিক্ষিতের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি। উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করতে না পারার দিক থেকেও এগিয়ে বিএনপি।
আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে বিজয়ীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষা ও স্বল্প শিক্ষা উভয় দিক থেকেই দলগতভাবে বিএনপি এগিয়ে আছে। তবে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম না করতে পারার দিক থেকে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ।
মামলা ঢাকা উত্তরে দলগতভাবে বর্তমান মামলার ক্ষেত্রে বিএনপি এবং অতীত মামলার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন। আর দক্ষিণে বর্তমান মামলা ও অতীত মামলা উভয় ক্ষেত্রেই বিএনপির প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন।
প্রার্থী ও নির্ভরশীলদের বাৎসরিক আয় সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা উত্তরে দলগতভাবে স্বল্প আয়ের দিক থেকে বিএনপি এবং অধিক আয়ের দিক থেকে আওয়ামী লীগ এগিয়ে আছে। আর দক্ষিণে দলগতভাবে স্বল্প ও অধিক আয়ের দিক থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন।
প্রার্থী ও নির্ভরশীলদের সম্পদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা উত্তরে দলগতভাবে স্বল্প সম্পদের দিক থেকে বিএনপি এবং অধিক সম্পদের দিক থেকে আওয়ামী লীগ এগিয়ে আছে। আর দক্ষিণে দলগতভাবে স্বল্প সম্পদের দিক থেকে আওয়ামী লীগ এবং অধিক সম্পদের দিক থেকে বিএনপি এগিয়ে আছে।
দায়-দেনা ও ঋণ সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা উত্তরে দলগতভাবে ঋণগ্রহণে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এগিয়ে আছে। বিএনপি থেকে বিজয়ীদের কারও ঋণ নেই। আর দক্ষিণে দলগতভাবে ঋণগ্রহণে সংখ্যাগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও শতকরা হারে বিএনপি এগিয়ে আছে।
কর সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা উত্তরে দলগতভাবে কর প্রদানের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এগিয়ে আছে। আর দক্ষিণেও দলগতভাবে কর প্রদানে আওয়ামী লীগ এগিয়ে আছে।
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের কতটা সুষ্ঠু হয়েছে, সে বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে সুজন সম্পদক বদিউল আলম বলেন, ‘ঢাকা দুই সিটির নির্বাচন ছিল ভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ও ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) জন্য একটা অগ্নিপরীক্ষা ছিল। তারা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। আর অনেকগুলো অভিযোগ উঠেছে, এগুলো তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্ত হলেই সত্যিকারভাবে যা ঘটেছে, সেটা বেরিয়ে আসবে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একটি প্রচার আছে যে, নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ। আমরা মনে করি, এই শান্তি অশান্তির চেয়েও ভয়াবহ। কেননা, ভয়ের সংস্কৃতির কারণে কেউ যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস না পায়, তবে সেই অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়া দুষ্কর। ব্যাপক অনিয়ম হওয়ার পরেও যদি সেই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়, তবে বুঝতে হবে প্রতিপক্ষ এখানে চরম দুর্বল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি স্পষ্ট যে, সামগ্রিকভাবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। তবে অতীতের তুলনায় নিয়ন্ত্রণের ধরন ছিল কিছুটা ভিন্ন। অবস্থা দৃষ্টি মনে হচ্ছে, এই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনগুলো যেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।’
পিডি/এনএফ/এমকেএইচ