কিশোরী গৃহকর্মীর প্রতি এ কেমন বর্বরতা!
মেয়েটির পাসহ শরীরের কয়েকটি স্থানে পচন ধরেছে, একটি পায়ে পচে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। দেখলে যে কেউই আঁতকে উঠবে। ওই পা কেটে ফেলা হতে পারে বলে জানিয়েছেন সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন। মেয়েটিকে প্রায় তিন মাস ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
এর আগে প্রায় এক বছর ধরে চলে মেয়েটির ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন। তারপর বিনা চিকিৎসায় ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। মঙ্গলবার পরিবারের সদস্যরা বন্দি অবস্থা থেকে উদ্ধার করে তাকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করেন।
মেয়েটির নাম নাজমা বেগম (১৬)। অভাবের সংসারে ঘরে কিছু বাড়তি টাকা নিয়ে আসতে নাজমাকে পাশের গ্রামের রাবেয়া বেগমের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে পাঠিয়েছিলেন বাবা। বাড়তি টাকা নিয়ে আসার বদলে পচে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে আসে সে।
গৃহকর্মীর উপর এমন বর্বরোচিত নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপির পাঁচাপাড়া গ্রামে। এ ব্যাপারে মঙ্গলবার বড়লেখা থানায় তিনজনকে আসামিকে করে একটি মামলা দায়ের করেছেন নাজমার বাবা মনসুর আলী। মামলা দায়েরের পর পুলিশ গৃহকর্তী রাবেয়া বেগমকে গ্রেফতার করেছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের বিছরাবন্দ গ্রামের হতদরিদ্র মনসুর আলী অভাবের তাড়নায় মেয়ে নাজমা বেগমকে গৃহকর্মীর কাজে দেন পাঁচপাড়া গ্রামের আজির উদ্দিনের বাড়িতে।
প্রায় এক বছর পূর্বে মেয়েটিকে ঝিয়ের কাজের জন্য আজির উদ্দিনের স্ত্রী রাবেয়া বেগম নিজ জিম্মায় নাজমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। এর তিন মাস পর নাজমার পরিবারের অনুমতি ছাড়াই তাকে নিজের মেয়ে লুৎফার শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে পাঠিয়ে দেন রাবেয়া বেগম।
প্রায় তিন মাস পূর্বে থেকে নাজমা নিজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এ সময় নাজমার বাবা-মা মেয়ের খোঁজ করলেও রাবেয়ার পরিবার থেকে বলা হয়, তোমার মেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঈদের দিন মেয়েকে দেখতে বড়লেখার পাঁচপাড়া গ্রামের আজির উদ্দিনের বাড়িতে উপস্থিত হন নাজমার বাবা-মা। এ সময়ও নাজমা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে বলে জানান রাবেয়া। তবে রাবেয়ার মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামী আজির উদ্দিন ফাঁস করে দেন সব গোমর। তিনি মনসুর আলীকে বলেন, `ওই বেটা তর পুড়ি তো আমার ঘরো বন্ধি তিন মাস ধরিয়া। তর পুড়িরে লইয়া যা।`
এ কথা শুনে মনসুর আলী এলাকার লোকজনের সহযোগিতায় গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মেয়েকে উদ্ধার করেন। এ সময় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে পচন ধরেছে ও শরীর ক্ষতবিক্ষত ছিল। গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়েটিকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেয়েটি বর্তমানে হাসপাতালের চতুর্থ তলার ৬নং ওয়ার্ডের ৭নং বেডে চিকিৎসাধীন।
নাজমার পিতা মনসুর আলী জানান, আমি দরিদ্র মানুষ। আমার মেয়েটিকে ঝিয়ের কাজের কথা বলে প্রায় এক বছর আগে রাবেয়া বেগম তার বাড়িতে নিয়ে যান। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি আমাদের না বলে তার মেয়ে লুৎফা বেগমের শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন নাজমাকে।
মনসুর আরো বলেন, তারা আমার মেয়েকে বাসায় আটকে রেখে প্রতিদিন রুটি বানানোর বেলুন দিয়ে পেটাতো। প্রতিদিন চলতো নির্যাতন। চিকিৎসকরা বলেছেন নাজমার একটি পা কেটে ফেলতে হতে পারে। এছাড়া আমার মেয়েটির শরীরে নির্যাতনের অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন রয়েছে।
গত তিন মাস থেকে আমার মেয়ের সঙ্গে তারা কোনো যোগাযোগ করতে দেয়নি। আমরা যতবার ফোন দিয়েছি তারা বলেছেন, আমার মেয়েকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।
বড়লেখা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, এ ঘটনায় রাবেয়া বেগম, তার মেয়ে লুৎফা বেগম ও লুৎফার জা রুবিকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ রাবেয়াকে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। অন্য আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ছামির মাহমুদ/এআরএ/বিএ