বাংলাদেশ ক্রিকেট বাসি ফুল না যে ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়বে
বিলাসী গল্পে জীবনীশক্তির সবটুকু দিয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে মৃত্যুঞ্জয়কে ফিরিয়ে আনা কঙ্কালসার বিলাসী প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পি হিসেবে বিবেচিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন- ‘ঠিক যেন ফুলদানিতে সাজাইয়া রাখা বাসি ফুল, হাত দিলেই ঝুর ঝুর করিয়া ঝরিয়া পড়িবে।’ চরম দুরাবস্থা বোঝানোর জন্য শরৎচন্দ্রের এই কথাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। সম্প্রতি নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ সফর অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে সিএ (ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া) তথা অস্ট্রেলিয়া। এতে শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন অনেকেই। তবে কি বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আসর বন্ধ হয়ে যাবে? পাকিস্তানের দশায় পড়বে এদেশের ক্রিকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্ব থেকে এক ঘরে হয়ে পড়বে বাংলাদেশ? আগ বাড়িয়ে যারা এমনটা ভাবছেন তারা আসলে বাস করছেন বোকার স্বর্গে।
বাংলাদেশকে বাইরে রেখে ক্রিকেটে বিশ্বায়ন একটা অলীক ভাবনা। খেলাধুলা বিশেষ করে ক্রিকেটে, সফল আয়োজনের দক্ষতায় বাংলাদেশ এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। গত কয়েকটা বছরে সবচেয়ে বেশি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজক বাংলাদেশ। গত বছর মার্চ মাসে টি২০ বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে রাজনৈতিক অস্থিরতায় উত্তাল ছিল গোটা দেশ। গত বছর টি২০ বিশ্বকাপের আগে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সফরে আসে শ্রীলঙ্কা। ওই সময় দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কোন মাত্রায় ছিল সেটা নতুন করে না বললেও চলে। হরতাল আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় দিনের পর দিন বন্ধ হয়ে ছিল দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমন সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসলো শ্রীলঙ্কা।
ক্রিকেট মাঠে গড়াতেই পাল্টে গেল সবকিছু। পুরো দেশ হয়ে উঠল ক্রিকেটমুখী। পরপরই অনুষ্ঠিত হল এশিয়া কাপ। কোথাও এর এতটুকু ছন্দপতন ঘটেনি। পরের মাস অর্থাৎ মার্চ মাসে বসলো টি২০ বিশ্বকাপের আসর। বলা বাহুল্য ছেলেদের টি২০- বিশ্বকাপের সঙ্গে মেয়েদের টি২০ বিশ্বকাপের আয়োজকও বাংলাদেশ। গত বছরের টি২০ বিশ্বকাপ চলাকালীন প্রেসবক্সে বিদেশী সাংবাদিকরা বাংলাদেশের আয়োজনের প্রশংসায় ছিল উচ্চকণ্ঠ। স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে একাধিক ভারতীয় জার্নালিস্ট আমাদেরকে বলেছেন যে, তোমাদের আয়োজন খুবই চমৎকার। আমাদের দেশে হলে এত সুন্দর আর এতোটা সফল আয়োজন সম্ভব ছিল না।
বিশ্বকাপের পর থেকে গত কয়েক মাস ধরে প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট শক্তিগুলো বাংলাদেশ সফর করেছে নিয়মিতভাবে। পাকিস্তান, ভারতের পর নির্বিঘ্নে বাংলাদেশ সফর করে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ্বকাপে শ্রীনিবাসনের কারণে ভারতের সঙ্গে তৈরি হয় এক ধরনের তিক্ততা। কিন্তু দুদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে এর কোনোই প্রভাবই পড়ে নি। ভারতকে সফরে এনে সাংগাঠনিকভাবে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে বিসিবি তথা বাংলাদেশের ক্রিকেট কর্ণধাররা। এশিয়া কাপের সর্বশেষ দুটো আসরের আয়োজকও বাংলাদেশ। ক্রিকেটে নতুন মডেল দাঁড় করান শ্রীনিবাসন। এই মডেল অনুযায়ী, ক্রিকেটে অভিজাত ক্লাবে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। আর বাকিরা সাধারণের কাতারে। আইসিসির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এই তিন দেশের। একই সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিস্তর কাঠামোর ধারণাও আনা হয় সামনে। সহজ ভাষায় বললে, টেস্টে দ্বিস্তর কাঠামোয় র্যাংকিংয়ে উপরের দলগুলোর সঙ্গে খেলার সুযোগ খুবই সঙ্কুচিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় নিচু সারির দলগুলোর। এমন পরিস্থিতি খুবই দক্ষ হাতে সামলেছে বাংলাদেশ। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে টেস্ট ক্রিকেটের বড় দলগুলোর সঙ্গে বেশি সংখ্যায় দ্বিপক্ষীয় সিরিজে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ।
শুধু ক্রিকেটই বা বলি কেন? এ বছর জুড়েই আন্তর্জাতিক ফুটবলের মেলা বসেছে বাংলাদেশে। এ বছর জুন মাসে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশে খেলে গেছে কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে গত আগস্ট মাসে এশিয়া ফুটবলের অন্যতম শক্তি জর্ডানকে আতিথেয়তা দিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি এফসি অনূর্ধ - ১৬ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ সফর করেছে এশিয়া ফুটবলের অন্যতম দুই পরাশক্তি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। মাস দেড়েক আগে সাফ অনূর্ধ-১৬ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। সিলেটে অনুষ্ঠিত এ আসরকে মহিমান্বিত করেছে গ্যালারি ঠাসা দর্শক। শুক্রবার থেকে এফসি অনূর্ধ -১৯ বাছাই পর্ব শুরু হচ্ছে বাংলাদেশে। স্বাগতিকরা ছাড়াও এই আসরে খেলছে শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও উজবেকস্তান। মজাটা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া চূড়ান্ত হওয়া সফর স্থগিত করার সময়েই ঢাকাতেই বসছে এই ফুটবলের আসর।
আর ঠিক এ সময়টাতেই বাংলাদেশে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ কোনো নিরপেক্ষ ভেন্যুতে নেয়ার চেষ্টা করছে অস্ট্রেলিয়া ফুটবল কর্তাব্যক্তিরা। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ খেলতে আগামী নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে আসার কথা অস্ট্রেলিয়া ফুটবল দলের। এই ম্যাচ যাতে বাংলাদেশে খেলতে না হয় এর জন্য এএফসির কাছে চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। মজাটা হচ্ছে, বাংলাদেশের মতই অস্ট্রেলিয়ানদের জন্য তাজিকিস্তানও চিহ্নিত হয়েছে একই ধরনের ঝুকিপূর্ণ এলাকা হিসাবে। কিন্তু তাজিকিস্তানে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেও ম্যাচ খেলতে বাধ্য হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। কেননা এএফসি তথা ফিফার ওপর প্রভাব খাটানো এত সহজ ব্যাপার নয়। এফসি অনূর্ধ-১৯ বাছাইপর্ব আয়োজনে যদি আগের মতই সুনাম ধরে রাখতে পারে তাহলে, বাংলাদেশে না এসে কোনো উপায় থাকবে না অস্ট্রেলিয়া ফুটবল দলের।
ক্রীড়া প্রেম তথা বাংলাদেশের মানুষের ক্রিকেট প্রেম আন্তর্জাতিক বিশ্বে এক আলোচিত বিষয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আয়োজনের দক্ষতা, সাংগঠনিক মুন্সিয়ানা সর্বোপরি ময়দানী নৈপুণ্য। সব কথার এক কথা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ এক পরিপূর্ণ প্যাকেজ। এই পুর্ণাঙ্গ প্যাকেজকে হেলায় হারানোটা যে কারও জন্য প্রায় দুঃসাধ্য। এ বছর ময়দানী দক্ষতা দিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেরা আটে জায়গা করে নিয়েছে টাইগাররা। মনে রাখতে হবে সেরা আটে জায়গা করে নিতে পারেনি ক্রিকেটের কুলীন দল ওয়েস্টইন্ডিজও। পাকিস্তানের মত প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট শক্তিকে পেছনে ফেলে ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে ৭ নম্বরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আর অস্ট্রেলিয়ার উন্নাসিকতা কম দেখেনি ক্রিকেট বিশ্ব। ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে শ্রীলঙ্কায় ম্যাচ বয়কট করেছিল অস্ট্রেলিয়া। ওই বিশ্বকাপে ফাইনালে লংকানদের কাছে হেরেই রানার্সআপ ট্রফি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের।
এশিয়ান দেশগুলোকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার নাক উঁচু মনোভাবের এমনি অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। আর তাই কোনো সফর অস্ট্রেলিয়া বর্জন করলে সেটাকে আর যাই হোক মানদণ্ড হিসাবে ধরার কোনো বাস্তবতা নাই। সামনেই বিপিএল। আশা করা যায় আগের দুই আসরের মতই বিশ্ব মাতানো ক্রিকেটাররা আলো ছড়াবেন এবারের বিপিএলেও। বিশ্বমানের ক্রিকেটারদের বিপিএলে ভিড়িয়ে বরাবরের মতই সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দেবেন আমাদের ক্রিকেট কর্তাব্যক্তিরা, এই আস্থা আমরা রাখতেই পারি। এরপর নিয়মিতভাবেই ক্রিকেটের জমকালো আসর বসবে বাংলাদেশে, এর বাইরে অন্য কিছু ভাবার কোনো অবকাশ নাই।
বাসি ফুল নয়, ১৬ কোটি মানুষের তীব্র ভালোবাসা আর আবেগে গড়ে ওঠা বাগানের টাটকা ফুল বাংলাদেশ ক্রিকেট। এই টাটকা ফুলের সৌরভে মাতোয়ারা ক্রিকেট বিশ্ব। নতুন প্রাণের ঢেউ তোলা এই বাংলাদেশ ক্রিকেটকে উপেক্ষা করার সাধ্য নাই কারও।
এইচআর/এমএস