স্বপ্ন তার ২৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছানোর

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:৪০ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯

২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে ব্র্যাক যেন পৌঁছে যায়, সেই স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস চেয়ার স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

তার স্বপ্ন ছিল, ‘ব্র্যাক আগামীতে আরও বড় হবে, নতুন উদ্ভাবন চালিয়ে যাবে এবং নতুন দিনের প্রয়োজনে নতুন সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে।’ অনেকেই তার কাছে ব্র্যাক মানে কী- এমন প্রশ্ন করেছিল। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ব্র্যাক শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নাম নয়, ব্র্যাক একটি স্বপ্ন, একটি প্রচেষ্টা। এটি এমন একটি পৃথিবীর প্রচেষ্টা, যেখানে সব মানুষ তার সম্ভাবনা বিকাশের সমান সুযোগ লাভ করবেন।’

স্বপ্ন দেখা সেই মানুষটি আর নেই। শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং তিন নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত এনজিও হিসেবে ব্র্যাক আজ পরিচিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তৃণমূলের মানুষের সেবা করতে গিয়ে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। এজন্য লন্ডনের নিজ ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেন তিনি। সেই থেকে শুরু। পরবর্তীতে এক লাখ কর্মী নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর ১১টি দেশের ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে চলেছে ব্র্যাক। বেসরকারি উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া ফজলে হাসান আবেদ সমাজকর্মের জন্য ‘স্যার’ উপাধি পাওয়া ছাড়াও বিশ্বের বহু সম্মানিত পুরস্কার পেয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানিত করেছেন।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ যে সবসময় সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করতেন- সেটা ফুটে উঠল ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহের কথায়। রাতেই অ্যাপোলো হাসপাতালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ সবসময় সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর যখন উনার মুখে অক্সিজেন লাগানো তখনও তিনি তার মেয়েকে ডেকে বলেছেন, আমাদের নতুন স্কুলগুলোকে কিন্তু মডেলে পরিণত করতে হবে।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক নিয়ে তার কোনো স্বপ্ন বা দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন কি-না? জবাবে আসিফ সালেহ বলেন, গত ৪/৫ মাস ধরে তিনি ব্র্যাকের গ্লোবাল গভর্নেন্স নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। একটি গ্লোবাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে যেখানে তিনজন সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সেই গ্লোবাল বোর্ডের মাধ্যমে ব্র্যাকের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এছাড়া আমরা যারা কর্মী রয়েছি তারা সবাই মিলে ব্র্যাককে এগিয়ে নিয়ে যাব।

তিনি বলেন, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি ব্র্যাক শুরু করেন। বিদেশে ভালো চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন, দেশের জন্য কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে। ব্র্যাকের কার্যক্রম এখন ১৪টি দেশে আছে। তিনি সবসময় বলতেন, ব্র্যাক শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, একটি স্বপ্ন। যেটা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার জন্য। সেই স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে আমরা সবাই মিলেই কাজ করব।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আরও জানান, রোববার (২২ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আর্মি স্টেডিয়ামে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ রাখা হবে। দুপুর সাড়ে ১২টায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজার পরে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

গত ৭ আগস্ট ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর নেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ৪৭ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে তিনি ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির বিষয়টিকে তুলে ধরেন। এমনকি ভবিষ্যতে ব্র্যাককে কোন অবস্থানে দেখার স্বপ্ন দেখেন তিনি, বিদায়ের মুহূর্তে একটি চিঠির মাধ্যমে কর্মীদের সে কথাও জানান। তার আবেগঘন ওই চিঠি নাড়া দেয় ব্র্যাকের প্রতিটি কর্মীকে।

ভবিষ্যৎ নেতৃত তৈরির বিষয়ে ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিগত কয়েক বছরে আমি ব্র্যাকে আমার পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে অনেক ভেবেছি এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি। ব্র্যাকের জন্য এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, যাতে আমার অবর্তমানেও ব্র্যাক তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারে। আমি একটি পেশাদার ও সুশৃঙ্খল পালাবদল নিশ্চিত করতে চাই।’

চিঠির ভাষ্যানুযায়ী, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির বিষয়টি তার মাথায় আসে ২০০১ সালে যখন তিনি ৬৫ বছর বয়স পূর্ণ করেন। তিনি চিঠিতে লেখেন, ‘তখন ঠিক করলাম, ব্র্যাকের নেতৃত্ব অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আমি নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। ব্র্যাকের কাজ পরিচালনা করার জন্য তখন নতুন একজন নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ দেয়া হলো। আমি ব্র্যাকের বোর্ড সদস্য হলাম। সে সময় ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন কবীর। তিনি প্রস্তাব করলেন, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতারই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন হওয়া উচিত। তখন থেকেই আমি ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হলাম।’

‘আমার বয়স এখন ৮৩ বছর। আমি মনে করি, চেয়ারপারসন হিসেবে ব্র্যাক এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের বোর্ডের সক্রিয় ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়াবার এটিই সঠিক সময়। তাই আমি ব্র্যাক বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল সুপারভাইজরি বোর্ডের চেয়ারপারসনের পদ থেকে অবসর নিচ্ছি। ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদ আমাকে ব্র্যাকের চেয়ার ইমেরিটাস নির্বাচিত করেছেন। আমি এখনও নিয়মিত অফিসে আসব। তবে আগামী কয়েক মাস আমি ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল এবং পরিচালনা কাঠামো নির্ধারণের বিষয়ে মনোযোগ দেব।’

আগামী দিনের ব্র্যাক কেমন হবে- সে স্বপ্নের কথাও উল্লেখ করেন চিঠিতে। বলেন, “ব্র্যাক তার যাত্রা শুরু করেছিল ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি’ এ নাম নিয়ে। এখন কেউ আমাকে যখন জিজ্ঞাসা করেন ব্র্যাক মানে কী? আমি তাদেরকে বলি- ব্র্যাক শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নাম নয়, ব্র্যাক একটি স্বপ্ন, একটি প্রচেষ্টা। এটি এমন একটি পৃথিবীর প্রচেষ্টা, যেখানে সব মানুষ তার সম্ভাবনা বিকাশের সমান সুযোগ লাভ করবেন।”

‘আগামী ১০ বছরে আমরা আমাদের কাজের প্রভাব পৃথিবীর আরও বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে ব্র্যাক যেন পৌঁছে যায়, সেটিই আমার প্রত্যাশা। আমি স্বপ্ন দেখি-ব্র্যাক আগামীতে আরও বড় হবে, নতুন উদ্ভাবন চালিয়ে যাবে এবং নতুন দিনের প্রয়োজনে নতুন সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে।’

ফজলে হাসান আবেদ ছাড়া ব্র্যাক কি সম্ভব- এমন প্রশ্নেরও উত্তর দিয়ে যান চিঠিতে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করলেও ব্র্যাককে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার পেছনে সব পরিশ্রম করেছেন ব্র্যাকের কর্মীরা। আমার একার পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না। জীবনভর যে আস্থা, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, সমর্থন ও অঙ্গীকার তোমাদের কাছ থেকে আমি পেয়েছি, তার জন্য শুধু ধন্যবাদ দিয়ে তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা আমি বোঝাতে পারব না। তোমরা তোমাদের সীমাহীন সাহস দিয়ে সবসময় আমার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে এসেছ। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্র্র্যাক বোর্ডের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর নিলেও, আমি তোমাদের পাশেই আছি। আগামী দিনগুলোতে আমি ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বিশ্বব্যাপী আমাদের অবস্থান কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়, তা নিয়ে কাজ করে যেতে চাই।’

শেষ চিঠিতে ‘আমার গল্প’ নামের অংশে তিনি তার জীবনের শুরুর সময়ের কথা সহকর্মীদের সঙ্গে শেয়ার করেন। তিনি শিক্ষাজীবনের কথা বলতে গিয়ে লেখেন, ‘১৮ বছর বয়সে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আমি লন্ডনে চলে যাই। সেটি ছিল ১৯৫৪ সাল। সেই থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত টানা ১৪ বছর আমি লন্ডনেই ছিলাম। সেখানে প্রথমে আমি চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে লেখাপড়া শেষ করলাম। তারপর বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে অ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে চাকরি করলাম। এক সময় যোগ দিলাম শেল অয়েল কোম্পানির অ্যাকাউন্টস সেকশনে। এরপর শেলের হয়েই ফিরে আসি দেশে-চট্টগ্রামে।’

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ অকপটে বলেন, ‘তরুণ বয়সে এনজিও গড়ে তুলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে কাজ করব, এরকম কোনো ভাবনা আমার একেবারেই ছিল না। যথেষ্ট সচ্ছল পরিবেশে আমি বড় হয়েছি। একেবারেই ভিন্ন ধরনের বিলাসী জীবন ছিল আমার। ব্র্যাকের শুরুটা আমার জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প।’

এমএআর/আরএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।