গোলাম আরিফ টিপুর ‘দুঃখ’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারসহ গোটা বাঙালি জাতির পবিত্র আমানত। সেই মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত রাজাকারের তালিকায় আমার নাম যুক্ত থাকায় আমি হতবাক, বিস্মিত, মর্মাহত ও অপমানিত।’
‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রাজাকারের তালিকা প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সীমাহীন অযত্ন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে এ তালিকা প্রচার-প্রকাশ করেছে। বিষয়টি প্রমাণিত।’
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে এভাবে নিজের আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন গোলাম আরিফ টিপু।
তিনি বলেন, ‘গত রোববার (১৫ ডিসেম্বর) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় মন্ত্রী জনাব আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তাসহ গণমাধ্যমের সামনে বিলম্বে হলেও একাত্তরের রাজাকারদের তালিকা প্রচার ও প্রকাশ করেন। উক্ত তালিকায় রাজশাহী বিভাগের ক্রমিক নং ১১, ৮৯ পূর্বের নথির ক্রমিক নম্বর ৬০৬ নথি নম্বর আইআর-১৬/৭-এর ঠিকানাবিহীন চতুর্থ নম্বর মিস্টার এমডি গোলাম আরিফ অ্যাডভোকেট লেখা আছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হওয়ায় বিষয়টি প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে।’
গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার কর্মময় ঘটনাবহুল জীবন, বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আপনারা প্রচার-প্রকাশ করেছেন। আমি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫৪, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০ এবং ঐতিহাসিক মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। এটিও জানেন, আমি একুশে পদকপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২২/০৭/১৩ ইংরেজি তারিখে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা জেলা রাজশাহীর পৃষ্ঠা নম্বর ৬৮৩৭, ক্রমিক নং-৩৩ তালিকাভুক্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা আমি। মন্ত্রণালয় আমাকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদান করেছে। আমি ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।’
‘আপনারা ইহাও অবগত, বর্তমান সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্বটি পালনের জন্য যাচাই-বাছাই পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে আমাকে ২০১০ সালের ২৮ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ করেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিকট জোর দাবি, তারা তাদের ভুল অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন এবং অনতিবিলম্বে ভুল সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করবেন।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া তালিকা ধরেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ তালিকা প্রকাশ করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় এসব নাম কখন, কীভাবে, কেমন করে যেতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে অন্য প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা যখন হয়, সেই প্রতিষ্ঠার দিন থেকে, দিনটি আমার খুব ভালো মনে আছে, এপ্রিল মাসের বোধহয় ১৮ তারিখ। বিজ্ঞ চিফ প্রসিকিউটর আইন মন্ত্রণালয়ে ২৮ দফা করণীয় সম্পর্কে একটি লিখিত আবেদন জমা দিয়েছিলেন। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়। তার ধারাবাহিকতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা বহুবার মানবতাবিরোধী অপরাধের সংশ্লিষ্টদের তালিকা, তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বহুবার চিঠি দিয়েছি। আপনারা এটাও জানেন যে, অদ্যাবধি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো তথ্য-উপাত্ত, কোনো তালিকা সরবরাহ করা হয়নি। বরং এটাও আপনারা জানেন, ইস্ট পাকিস্তান সিক্রেট রিপোর্ট, যে রিপোর্টের কপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত থাকার কথা সেই রিপোর্ট আমরা উদ্ধার করি চুয়াডাঙ্গা থেকে, যা আমরা ৪১টি মামলায় ব্যবহার করে আসলাম।’
‘এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠালগ্নে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ আব্দুল মতিনকে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। যে মতিন ইসলামি ছাত্রসংঘের বরিশালের সভাপতি ছিলেন, বরিশাল বিএম কলেজে শ্রদ্ধেয় নেতা আমির হোসেন আমু তার সঙ্গে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, একাত্তরে জুডিশিয়াল সার্ভিসে জয়েন করে নয় মাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলেন। সেই লোককে জাতির এ গুরুত্বপূর্ণ কাজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কীভাবে নিয়োগ দিয়েছিল সেই জবাব জাতি এখনও কিন্তু পায়নি। জবাবটা আমাদেরও জানা নাই।’
‘ফলে আজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যখন এ ধরনের তালিকাগুলো প্রকাশিত হয়, বিজ্ঞ চিফ প্রসিকিউটর মহোদয় যেটা বলেছেন যে, এটা থেকে আর অনুধাবন করার বাকি থাকে না যে, জামায়াত-শিবিরের অনুসারীরা, তারা আজ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে চেপে বসে আছে এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তারা এ ধরনের সাবোটাজের চেষ্টা করছে, এটা হয়তো তারই ফল।’
‘এটি আমাদের গোটা জাতির জন্য লজ্জার’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আজ গোলাম আরিফ টিপু শুধু একজন ব্যক্তি নন, আজ তিনি একটি প্রতিষ্ঠান এবং আপনাদের সহায়তা নিয়ে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমরা যে কাজটি করছি, শুরু থেকেই কাজটির ভেতরে ও বাইরে ষড়যন্ত্র ছিল, এখনও আছে। এটি সেই ধরনের ষড়যন্ত্রের একটি বহিঃপ্রকাশ।’
প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন বলেন, ‘এ তালিকা কেবল আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’
‘ছয় মাস ধরে যে সব অফিসার এ তালিকা তৈরি করেছেন, তাদের নিয়োগ দিল কে এবং কীভাবে এটি প্রকাশিত হলো, সেখানে কেন দেশের যারা প্রমিনেন্ট মুক্তিযোদ্ধা আছেন, প্রত্যেকটা জেলায় আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ আছেন, মুক্তিযোদ্ধারা এখনও জীবিত আছেন, প্রত্যেকটা জেলার খবরাখবর তারা নিতে পারতেন। এটা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সেখানে তারা যাচাই-বাছাই করতে পারতেন। সেটা ভেরিফাই করা হয়েছে কি-না, আজ যারা সরকারে চাকরি করছেন, একজনও মুক্তিযোদ্ধা নাই, যদিও কন্ট্রাক সার্ভিসে দু-একজন থাকেন…, আমাদের ট্রাইব্যুনালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন…।’
‘কিন্তু যারা সরকারে চাকরি করছেন, বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী, একজনও মুক্তিযোদ্ধা নাই। এখন যারা সরকারের বিভিন্ন পদে আছেন, তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের পরিচয় জানা দরকার। আমি এটা জোরালোভাবে বলতে চাই, এ তালিকা যারা তৈরি করেছেন, এ তালিকা প্রণয়নের সময় কোন কোন সদস্য ছিলেন, কার নির্দেশে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে, তাদের সব পরিচয়, সবকিছু আমি ডিজিএফআই, এনএসআইকে অনুরোধ করব, সরকারকে অনুরোধ করব, প্রত্যেকটা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে অনুরোধ করব, এ তালিকা প্রণয়নে কারা কারা ছিলেন, কাদের স্বাক্ষর রয়েছে, খুঁজে বের করতে।’
মহান বিজয় দিবসের আগের দিন রোববার (১৫ ডিসেম্বর) মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকারদের প্রথম পর্বের তালিকা প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। ওই তালিকায় ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের নাম স্থান পায়। তবে ঘোষিত তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নামও রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গোলাম আরিফ টিপুসহ রাজশাহীর আরও দুই ব্যক্তির নাম রয়েছে ওই তালিকায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে।
রোববার জাগো নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গোলাম আরিফ টিপু বলেন, ‘সারাজীবন দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাটিয়ে দিলাম আর আজ এই অভিযোগ পেলাম। আমি ব্যথিত, মর্মাহত। আমি বিষয়টি সিরিয়াসলি নিচ্ছি এবং কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিতে চাই না। আমি কোনো দুর্বলতা দেখাতে চাই না।’
তিনি বলেন, ‘অন্যভাবে সমাধান না হলে, আদালতে গিয়ে আইনের আশ্রয় নেব। সারা জীবন বাঙালি, দেশের জন্য লড়াই করেছি। এভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই।’
এদিকে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম চলে আসায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি এ-ও বলেছেন, ভুলের পরিমাণ বেশি হলে রাজাকারের তালিকা প্রত্যাহার করা হবে। আর ভুলের পরিমাণ কম হলে ভুলবশত যাদের নাম এ তালিকায় এসেছে, সেগুলো প্রত্যাহার করা হবে।
এফএইচ/এমএআর/এমএস