ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পরিচিতি হারাচ্ছে ভারত

জেসমিন পাপড়ি
জেসমিন পাপড়ি জেসমিন পাপড়ি , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৫৮ পিএম, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯

নিম্নকক্ষ লোকসভার পর উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায়ও পাস হয়ে গেল ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি। এর ফলে বিলটি আইনে পরিণত হতে চলেছে। তবে সংসদের উভয়কক্ষে তুমুল বিতর্কিত বিলটি পাস করার প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে উঠেছে সারা ভারত। আইনটি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে বাংলাদেশেও।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারত এতদিন ধরে নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক’ রাষ্ট্র বলে পরিচয় দিয়ে এলেও এই বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনটির মাধ্যমে তারা সেই পরিচয়টি হারিয়ে ফেললো। এমনকি তাদের ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচয়ই প্রকাশ্য হয়ে গেল। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশেও এই আইনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, ধর্মীয় বিবেচনায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের তৈরি বিলটি নিয়ে সংসদের উভয়কক্ষে দীর্ঘ ও তুমুল বিতর্কের পর আইনপ্রণেতারা সমর্থন দিয়ে দেন। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলেই বিলটি এখন আইনে পরিণত হবে।

নতুন এই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অমুসলিমরা ‘ধর্ম, প্রাণ ও সম্মান রক্ষার তাগিদে অত্যাচারিত হয়ে’ ভারতে গেলে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আগের আইন অনুযায়ী কেউ ১২ বছর ভারতে থাকলে দেশটির নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য বিবেচিত হতেন। সংশোধিত আইনে এই সময়সীমা অর্ধেক কমিয়ে ছয় বছর করা হয়েছে।

বিলটি উত্থাপনকালে এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী প্রত্যেককে নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য এই বিল।’

Tareque

তবে এই বিলের তুমুল সমালোচনা করছে ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেসসহ বিরোধী রাজনৈতিক শিবির ও সুশীল সমাজ। ধর্মীয় বিবেচনায় দেশের একটি সম্প্রদায়কে (মুসলিম) বিতাড়িত করতে এমন বিলের বিরোধিতায় দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচিও নিয়েছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদাতা কংগ্রেস।

বিলটি প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতের সংবিধানে বলা আছে মানুষে মানুষে ধর্মীয় বিভেদ তৈরি করা যাবে না। অথচ এই আইনে মুসলিমদের অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ফলে এটি ভারতের সংবিধান পরিপন্থী।’

‘তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভারতের ক্ষমতাসীন মোদি সরকার এই বিল পাস করেছে। বিশ্বের দরবারে ভারতের অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক দেশ বলে যে সুনাম ছিল তা এই বিল পাসের সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেল।’

বিলটি পাসের মাধ্যমে ভারত একটু একটু করে একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। এমন ধর্মীয় বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর অনেকেই অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে তাদের সংগঠিত করে সরকার এবং পাশাপাশি ভারতবিরোধী জনমত গড়ে তুলতে পারে কোনো একটি গোষ্ঠী।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য ভারতকে আমাদের প্রয়োজন আছে। চীনকেও প্রয়োজন আছে। ফলে এমন কোনো অবস্থা যেন না হয়, যাতে ভারতের মানুষ বা বুদ্ধিজীবীদের কাছে আমাদের একটা খারাপ ইমেজ চলে যায়। কিন্তু কোনো শক্তি সেটাকে পুঁজির মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে ভারতবিরোধী অবস্থান নিলে তা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ভালো হবে না।’

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনও বলেছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি আইনে পরিণত হলে ধর্মনিরপেক্ষ দেশের অবস্থান থেকে পদস্খলন হবে ভারতের। দেশটির অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহাসিক অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে।

assam

তবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অভিযোগ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এনেছেন তা প্রত্যাখ্যান করেছে ড. মোমেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি বিশ্বে উদাহরণ। এখানে নির্যাতনের কোনো দৃষ্টান্ত নেই।’

নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানের নাগরিকদের বেছে নেওয়ার কারণ জানিয়ে অমিত শাহ বলেন, ‘তিন দেশেরই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এসব দেশে দিনের পর দিন সংখ্যালঘুদের হার কমছে।’

বাংলাদেশের ‘হিসাব’ জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২২ শতাংশ। ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

এই জনগোষ্ঠী কোথায় গেল প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘হয় তাদের ধর্ম পরিবর্তন করা হয়েছে, নয়তো খুন করা হয়েছে। কিংবা অত্যাচারিত হয়ে তারা ভারতে চলে এসেছেন। এই অত্যাচারিতদের আমরা রক্ষা করতে চাই। সম্মান দিতে চাই।’

এ বিষয়ে বুধবার (১১ ডিসেম্বর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও ড. মোমেন বলেন, ‘আমি মনে করি, এ ব্যাপারে যে কথা উঠেছে সেগুলো সত্য নয়। আমাদের দেশে সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় নির্যাতন হয় না। আমাদের দেশে ধর্ম যার যার। কিন্তু উৎসব সবার। এখানে অন্য ধর্মের কেউ নির্যাতিত হয় না। সম্প্রতি বিদেশ থেকে আমাদের অনেক লোক দেশে ফিরে আসছে। কারণ, আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছি। এখানে সব ধর্মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে।’

জেপি/এইচএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।