ঢাকায় এখন ধুলার রাজত্ব
রাজধানী ঢাকা দিনদিন দুর্ভোগের নগরীতে পরিণত হচ্ছে। কোনো মৌসুমেই নগরবাসী স্বাচ্ছন্দ্যে রাস্তাঘাটে চলাচল করতে পারে না। বর্ষাকালে রাজধানীবাসীকে ভুগতে হয় জলাবদ্ধতায় আর শুষ্ক মৌসুমে পোহাতে হয় ধুলার দুর্ভোগ।
শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা মহানগরীতে ধুলাদূষণের প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। শুষ্ক মৌসুম আসার আগেই রাজধানী ঢাকায় শুরু হয় ধুলার বিপদ। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ঢাকার প্রায় সব রাস্তাই একযোগে খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে। ঢাকায় যে হারে উন্নয়ন কাজের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে তাতে দূষণের মাত্রা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ না হলে রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধের কোনো বিকল্প পথ প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে না।
অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। গত রোববার (২৪ নভেম্বর) দুপুর ১টায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক অর্থাৎ বায়ুমান সূচক (একিউআই) ঢাকার অবস্থান জানিয়েছে ১৬৭, যা অস্বাস্থ্যকর। সবশেষে বিকেল ৩টার দিকে ছাড়িয়ে যায় ১৭৪। বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণা ও চার ধরনের গ্যাসীয় পদার্থ পরিমাপ করে এ সূচক তৈরি করা হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য অনুসারে, রাজধানীর বায়ুদূষণের ৫০ ভাগ হয় ইটভাটা থেকে, ৩০ ভাগ হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য থেকে। ১০ ভাগ দূষণ হয় গাড়ির জ্বালানি থেকে। শিল্প কারখানার বর্জ্য থেকে ১০ ভাগ। এই দূষণ কমাতে জরুরিভিত্তিতে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধের পাশাপাশি রাস্তাগুলোতে প্রতিদিন পানি দেয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে রাজধানীর অধিকাংশ রাস্তায় চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। এতে সৃষ্টি হচ্ছে ধুলা, ফলে বাড়ছে বায়দূষণ। রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা হাসিবুর রহমান বলেন, ‘রাজধানীর প্রায় সব এলাকায়ই চলছে রাস্তা খোঁড়াখুড়িসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ। ধুলার মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। মাস্ক ছাড়া রাস্তায় একটুও চলাফেরা করা যায় না। একটু হাঁটলে বা গণপরিবহনে চলাচল করলে জামা-কাপড়ে ধুলার আস্তরণ পড়ে যায়।’
গুলিস্তান, পল্টন, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা হয়ে চলাচলকারী ভিক্টর ক্লাসিক বাসের চালক আব্দুল গফুর বলেন, ‘সব রাস্তায় মাত্রাতিরিক্ত ধুলা। এ ধুলার কারণে বাসের সিটসহ যাত্রীদের পোশাকে ধুলার আবরণ পড়ে যায়। এমন কোনো রাস্তা নেই যেখানে গাড়ি চালাতে গিয়ে ধুলা ওড়ে না। যে কারণে আমাদের তো অবশ্যই, সঙ্গে পথচারীদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।’
রাজধানীতে ধুলার পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা রাস্তার দুপাশে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা এবং উন্নয়নকাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়িকে দায়ী করেছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। তারা বলছে, যানবাহন চলাচলের সময় ধুলাবালি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় ধুলা দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ধুলাদূষণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ধুলা দূষণে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে, তেমনি আর্থিক ও পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে ধুলা দূষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলছে পবা।
ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন নিয়মিত পানি ছিটানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায় পানি ছিটানো গাড়ি পরিচালনার প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, ‘কাকড়াইল থেকে মৎস্যভবন, গুলিস্তান রোড পর্যন্ত প্রতিদিন পানির গাড়ি দিয়ে তিনটি ট্রিপে পানি ছিটানো হয়। এছাড়া তোপখানা রোড, সেগুনবাগিচা, আনন্দবাজার, পলাশী, শাহবাগ, কাটাবন, সাতমসজিদ রোড, হাজারীবাগ, ঝিগাতলা, সায়েন্সল্যাব, নীলক্ষেত, হাতিরপুল, মগবাজার, কাকরাইল, শান্তিনগরসহ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন প্রায় সব এলাকায় সারাদিনে ২-৩ বার পানি ছিটানো হয়।’
এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণ রোধে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই কমিটিকে বায়ুদূষণ রোধে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং কী কী উপায়ে বায়ুদূষণ রোধ করা যায় সে ব্যাপারে সুপারিশ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। জনস্বার্থে পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
কমিটিকে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ এলাকায় অবৈধ ইটভাটা ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে রাজধানীর রাস্তা ও ফুটপাতে ধুলাবালি, ময়লা ও বর্জ্য অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে ঢাকা শহরের যেসব এলাকায় উন্নয়ন ও সংস্কার (রাস্তা ও নির্মাণাধীন কাজের জায়গা) কাজ চলছে, সেসব এলাকা ঘেরাও করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন এ আদেশ পালন করে দুই সপ্তাহের মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিবেশ অধিফতরের মহাপরিচালককে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এসব এলাকায় দিনে দুবার পানি ছিটাতে দুই সিটির মেয়র ও নির্বাহীদের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
অন্যদিকে রাজধানীর সড়ক খুঁড়ে রেখে ধুলা সৃষ্টিকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে আজ থেকে মাঠে নেমেছে পরিবেশ অধিদফতরের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
পরিবেশ অধিদফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজী তামজিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আজ থেকে রাজধানীর সড়ক খুঁড়ে রেখে ধুলা সৃষ্টিকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। পরিবেশ অধিদফতর থেকে আমাদের টিম বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এসব সড়ক খুঁড়ে রেখে ধুল সৃষ্টিকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
এএস/এসআর/এমকেএইচ