অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন তার গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্র সম্পর্কে যে কথাটি বলেছিলেন সেটিকেই এখন পর্যন্ত সর্বজন গ্রাহ্য গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বরে দুমিনিটকাল স্থায়ী প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি গণতন্ত্র বলতে ‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা পরিচালিত সরকার এবং জনগণের স্বার্থে পরিচালিত সরকার’ কে বোঝান। (অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল)।
এরপর বহু দেশে বহু ধরনের সরকার ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ও এসেছে নানা পরিবর্তন। সেনা শাসকরাও জোর করে ক্ষমতা দখল করে নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার বলে দাবি করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোয়ও অনেক সময় অনির্বাচিত সরকার, ক্ষমতাদখলকারী সরকারকে সমর্থন করেছে তাদের হীন স্বার্থে। বলা যায় বিশ্ব এখন ক্ষমতাশালীর পক্ষে, সেটা যেভাবেই হোক না কেন।
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে গণতন্ত্র বলতে আমরা বুঝি মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতাকে। তাই যেমন ইচ্ছা কথা বলতে পারাই এখানে গণতন্ত্র। কথার ফুলঝুড়ি ফোটাতে এখানে কারও কোনো জুড়ি নেই। টিভির টকশো থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গায়ের গলির চা দোকানেও কথায় কথায় রাজা উজির মারা চলে। সুতরাং কাজীর গরু গোয়ালে না থাকলেও কেতাবে ঠিকই আছে।
আমাদের দেশে সেই কেতাবী গণতন্ত্রই নিয়ে এখন আমরা আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি। এখানে জোটের রাজনীতি আর ভোটের রাজনীতিই প্রাধান্য পায় বেশি। জনস্বার্থ কতোটা সংরক্ষিত হল সেদিকে কারও কোনো নজর থাকে না। যেনতেন উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়াটাই মুখ্য ব্যাপার।
এ কথা ঠিক, রাজনৈতিক দলগুলো এনজিও নয়। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই রাজনীতি করে। তাই ক্ষমতায় যাওয়ার মধ্যে কিংবা যেতে চাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেখানে জনমানুষকেই সবার আগে স্থান দিতে হবে। এমনকি রাজনৈতিক দল চালাতে গিয়েও দিতে হবে গণতন্ত্রের পরিচয়। দলেই যদি গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকে তাহলে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হবে কী করে?
রাজনৈতিক দলগুলোই তো দেশ চালায়। তাদের সম্মিলিত আচরণই তো শাসনব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে। অনেক সময় এমন সব কথাবার্তা বলা হয় যা তার তা তাদের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতেই একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়। পরস্পরের প্রতি আস্থা বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। নেতানেত্রীদের সম্মিলিত আচরণই আসলে সেই সমাজ বা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিকশিত করতে সহায়তা করে। কাজেই নেতা-বা নেত্রীর একক আচরণও এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ নেতানেত্রীদের আচরণ দ্বারা অন্যরাও উৎসাহিত হন। সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হোক না কেন। এ জন্য তাদের আচরণের মধ্যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় থাকতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরমতসহিষ্ণুতা এবং পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাষাতেও রয়েছে শিষ্টাচারের অভাব। কে কার চেয়ে বড়, কিংবা কাকে কিভাবে ছোট করা যায় সব সময় এই ধরনের অসহিষ্ণু মানসিকতার বহির্প্রকাশ দেখা যায় রাজনীতিবিদদের কথাবার্তায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক একটি সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও মানসিকতা কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াই আসলে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমাদের দেশে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের চর্চা যত বাড়বে গণতন্ত্রের ভিত্তি ততই মজবুত হবে। প্রসঙ্গত, ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করতে হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবনও দিতে পারি।’
গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এই ধরনের মানসিকতা প্রদর্শন করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বৈরিতাপূর্ণ সমাজে বাকসংযম এবং তাতে শালীনতা রক্ষা একান্ত অপরিহার্য। দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কথাবার্তায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন এমনটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝেমধ্যেই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। এবং তা প্রায়শই ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি পর্যন্ত গিয়ে গড়ায়।
দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ প্রায়ই একে অপরের প্রতি উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন। কথার ফানুস উড়িয়েই চমক সৃষ্টি করতে চান। জনসভায়, কিংবা টিভি টকশোতে জনতার হাততালি কুড়াতে অনেকেই কথার লাগাম টানতে চান না। এতে কেউ কৌতুক বোধ করেন, কেউ বা সস্তা আমোদও পান। কিন্তু বক্তার ব্যক্তিত্ব যে এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেটি কি সংশ্লিষ্টরা বুঝতে অক্ষম?
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বক্তব্য হবে ধী শক্তিসম্পন্ন। মানুষজন বিশেষ করে ভবিষ্যত প্রজন্ম তা থেকে শিখবে। জ্ঞানার্জন করবে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের মতো নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি এখনও জাতিকে নতুন দিশা দেয়। তাই রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে এমন বিষয় থাকা উচিত যা অনুসরণযোগ্য, প্রেরণামূলক ও জনকল্যাণকর। অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল-এর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, টিভিউপস্থাপক।
[email protected]
এইচআর/এমএস