পেঁয়াজের ঝাঁজে নিম্নবিত্তের কান্না
প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। হু হু করে দাম বেড়ে নিত্যপণ্যটি এখন নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বাধ্য হয়ে রাজধানীর বিশাল একটি অংশ কম দামে পেঁয়াজ কিনতে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ট্রাকে ভিড় করছেন।
শনিবার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ২০০ টাকা। এর মধ্যে শেষ চারদিনের প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা করে বেড়েছে। দফায় দফায় দাম বেড়ে শনিবার পেঁয়াজের কেজি ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায় পৌঁছেছে।
যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বলেছেন, ‘পেঁয়াজ বিমানে উঠে গেছে। কার্গো বিমান ভাড়া করে পেঁয়াজ আনা হচ্ছে। কাল-পরশু পেঁয়াজ এলে দাম কমে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাদের কারণে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে বা দাম বেড়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
শনিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মিসর থেকে কার্গো বিমানযোগে আমদানি করা পেঁয়াজের প্রথম চালান ঢাকায় পৌঁছাবে মঙ্গলবার। এস আলম গ্রুপ বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করছে, এটি তার প্রথম চালান। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য আমদানিকারকদের আমদানি করা পেঁয়াজের কার্গো উড়োজাহাজ ঢাকায় পৌঁছাবে। চালানগুলো আসলে নিয়ন্ত্রণে আসবে পেঁয়াজের বাজার।
এদিকে, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের আড়তে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
রাজধানীর বাজার ঘুরে এবং নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেঁয়াজের বাড়তি ঝাঁজ সইতে পারছেন না নিম্ন আয়ের মানুষ। যে কারণে ৪৫ টাকা কেজি দরে টিসিবির পেঁয়াজ কিনতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভিড় করছেন তারা। এক কেজি পেঁয়াজের জন্য কাঠফাঁটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরপরও হাতে পেঁয়াজ পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন তারা। যেন সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতো।
শনিবার সকাল থেকে রাজধানীর সচিবালয় ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাঝের রাস্তায় টিসিবির ট্রাকে পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা যায়। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে থাকেন লাইনে।
দুপুর ১২টার দিকে কথা হয় রোকসানা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পেঁয়াজ নিতে পেরেছি। এরপরও আমি খুশি। কারণ বাজারে পেঁয়াজের যে দাম তাতে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। সকালে বাজারে গিয়ে দেখি এক কেজি পেঁয়াজের দাম ২৬০ টাকা। এখানে সেই পেঁয়াজ ৪৫ টাকা। হিসাব করে দেখেন, এখান থেকে পেঁয়াজ কিনলে কেজিতে ২১৫ টাকা বেঁচে যাচ্ছে।
পেঁয়াজ কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মারুফ হোসেন বলেন, দেড় ঘণ্টার বেশি লাইনে দাঁড়িয়েছি। সামনে এখনও ৫০ জনের মতো লোক। জানি না কখন শেষ মাথায় পৌঁছাব। এ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তার থেকে বড় কষ্ট পাচ্ছি বাজারে পেঁয়াজের দাম শুনে। এক কেজি পেঁয়াজের দাম ২৭০ টাকা। এটা অনেকটা কাল্পনিক গল্পের মতো। অথচ এটাই এখন বাস্তব চিত্র।
খাদেজা বেগম নামের এক ক্রেতা বলেন, ভাই গরিব হয়ে জন্মানো পাপ। তা না হলে কী পেঁয়াজ কিনতে এই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়! ২৭০ টাকা পেঁয়াজের দাম শুনলে আমাদের চোখে পানি আসে। কিন্তু যাদের টাকা আছে তাদের কিছু হয় না। উল্টো তারা পেঁয়াজের দাম নিয়ে হাসাহাসি করে।
ভারত রফতানি বন্ধ করায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকেই দেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। দফায় দফায় বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার খবরে ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ১০০ টাকায় পৌঁছে দেশি পেঁয়াজের কেজি। খুচরা পর্যায়ে ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকা কেজি বিক্রি হতে থাকে। এরপর বেশ কিছুদিন পেঁয়াজের দাম অনেকটা স্থির ছিল। ৭০-৮০ টাকা কেজিতে নেমে এসেছিল।
কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর আবারও পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে খেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং আমদানি করা পেঁয়াজ আসছে না- এমন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেন। এতে আবারও ১০০ টাকার ওপরে পৌঁছে যায় পেঁয়াজের কেজি।
এরপর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক বক্তৃতায় বলেন, পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকার নিচে নামানো সম্ভব নয়। মন্ত্রীর এমন বক্তব্য পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আরও উসকে দেয়। ১০০ টাকা থেকে পেঁয়াজের কেজি ১৩০ টাকায় পৌঁছে যায়। এ পরিস্থিতিতে শিল্পমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক আছে। পরের দিন পেঁয়াজের কেজি ১৫০ টাকা পৌঁছে যায়।
তবে এখানেই থেমে থাকেনি পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা। গত বুধবার ১৫০ টাকা থেকে পেঁয়াজের দাম এক লাফে ১৭০ টাকায় পৌঁছে। বৃহস্পতিবার সেই দাম আরও বেড়ে ২০০ টাকায় দাঁড়ায়। সপ্তাহের শেষদিন শুক্রবার তা আরও বেড়ে ২৫০ টাকায় পৌঁছায়।
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা চলতি সপ্তাহেও অব্যাহত রয়েছে। সপ্তাহের প্রথম দিন শনিবার কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। এর আগে কখনও দেশের বাজারে এত দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়নি।
রামপুরার হাসান বলেন, প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। গতকাল এক কেজি পেঁয়াজ ২৫০ টাকায় বিক্রি করেছি। আজ ২৬০ টাকা। কেউ কেউ ২৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। আমাদের কিছু করার নেই, পাইকারিতে প্রতিদিন দাম বাড়ছে।
তিনি বলেন, বুধবার শ্যামবাজার থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনেছি। বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ কিনি ২০০ টাকায়। গতকাল শুক্রবার শ্যামবাজারে পেঁয়াজের কেজি ছিল ২৩০ টাকা, আর আজ তা আরও বেড়ে ২৫০ টাকা হয়েছে। পাইকারিতে প্রতিদিন দাম বাড়লে আমাদের কী করার আছে?
এমএএস/এএইচ/জেআইএম