উত্তরাঞ্চলে পথে পথে চাঁদাবাজি!
উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার কোরবানির পশুবাহী হাজার হাজার যানবাহন যাচ্ছে রাজধানীতে। তবে এবারও কোরবানির পশুবাহী যানবাহন ঘিরে চাঁদাবাজ চক্র সক্রিয়। পথে পথে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন গরুর বেপারীরা।
সীমান্তের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছতে নানা কায়দায় গরু প্রতি পাঁচশ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে।
অভিযোগ আছে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, পরিবহন শ্রমিক সংগঠন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্য পশুবাহী যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোরবানি ঈদের আগে সীমাহীন চাঁদাবাজির এই মহোৎসব চলছে উত্তরাঞ্চল মহাসড়ক ঘিরে। বাস, ট্রাকসহ যেকোনো যানবাহন আটকে উঠানো হচ্ছে টাকা। তবে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চাঁদা উঠছে বেপরোয়াভাবে।
চাঁদাবাজরা কমিউনিটি পুলিশের ব্যানারে হলুদ পোশাক গায়ে লাগিয়ে মহাসড়কে ব্যারিকেড দিয়ে পণ্য ও গরুবাহী ট্রাক থামিয়ে আদায় করছে চাঁদার টাকা। সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা পর্যন্ত গরু প্রতি উঠছে এই চাঁদার টাকা। শুধু বগুড়া জেলার ১৫টি পয়েন্টে উঠছে চাঁদা। ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের নিজস্ব লোক নিয়োগ করে এই চাঁদা আদায় করছে।
এ ব্যাপারে জেলা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্য সচিব শাহাদৎ আলম ঝুনু জানান, মোটর শ্রমিক কিংবা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নে তাদের কোন ইউনিট নেই। যারা এই চাঁদা আদায় করছে তারা অবৈধ কাজ করছে। এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পুলিশের প্রতি অনুরোধ জানানো হবে।
জানতে চাইলে আন্ত:জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের বগুড়া জেলার সভাপতি আব্দুল মান্নান জানান, তাদের ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি ট্রাক থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। এটা ইউনিয়নের নিয়োগপ্রাপ্ত লোকরাই করে থাকে। এর বাইরে যেসব পয়েন্টে চাঁদা ওঠে সেটা করে মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। তাদের চাঁদা আদায়ের পরিমাণ ও স্থানের সংখ্যা বেশি। গরুর ট্রাক থেকে অতিরিক্ত চাঁদা আদায়ের কথা অস্বীকার করে মান্নান জানান, এ ধরনের কাজ কেউ করে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বগুড়া হাইওয়ে পুলিশের তথ্য মতো বগুড়ার দুটি বাইপাস মহাসড়ক ও মূল শহরের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১২০০ ট্রাক যাতায়াত করে। এগুলোর বেশির ভাগই বাইরের জেলার। মূলত চাঁদাবাজদের টার্গেটও বাইরের জেলার ট্রাক। কারণ এসব ট্রাকের চালকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ইচ্ছেমতো চাঁদা আদায় করা যায়।
গরু ব্যবসায়ীরা জানান, গরুবাহী ট্রাকে নীরব চাঁদাবাজি চলছে। ভয়ে অনেক ব্যবসায়ী মুখ খোলেন না। চাঁদা দিতে হয় ট্রাকে থাকা গরু গুনে গুনে। দেনদরবার করে চাঁদা পরিশোধ করেই তারা ব্যবসা করছেন।
আমিনুল ইসলাম নামে এক ট্রাক চালক জানান, কৌশলে গরুবোঝাই ট্রাক যানজটে আটকে রাখা হয় বাস কিংবা ট্রাকের ব্যারিকেড দিয়ে। চট করে খেয়াল করলে মনে হবে যানজটে আটকা পড়েছে। কিন্তুু আসলে তা নয়। চাঁদার টাকা দিলে ব্যারিকেট মুক্ত হওয়া যায়। নয়তো আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ মোটর শ্রমিক ও সরকার দলীয় শ্রমিক সংগঠন নামে-বেনামে এ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।
গরু ব্যবসায়ী আব্দুস শুকুর ও মিরাজুল জানান, কৃত্রিম যানজট সৃষ্টিসহ নানা কৌশলে পুলিশ, মোটর শ্রমিক ও বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান বলেন, যার যে পরিচয়ই থাক না কেন মহাসড়কে চাঁদা আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। আর কৃত্রিম যানজট সৃষ্টিরতো প্রশ্নই আসে না। এ ব্যাপারে নজরদারি আগের চাইতে আরো বাড়ানোর কথা বলেন তিনি।
ট্রাক চালকদের তথ্য অনুসারে উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে ডালিয়া-পাগলাপীর সড়ক হয়ে রংপুর আসতে গরুর ট্রাকগুলোকে ৫টি স্থানে চাঁদার টাকা গুনতে হচ্ছে। পঞ্চগড় থেকে দিনাজপুর ও রংপুর হয়ে ঢাকা যেতে কেবল বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাশ পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে ট্রাক প্রতি এক থেকে দুই হাজার টাকা। তবে অধিকাংশ স্থানেই চাঁদা দিতে হয় ট্রাকে থাকা গরুর সংখ্যার উপরে। একই ভাবে ১৭টি স্থানে টাকা গুনতে হয়। ফলে প্রতি গরুপ্রতি দাম বাড়ছে গড়ে প্রায় ২ হাজার টাকা।
বঙ্গবন্ধু সেতু পার হলেই কয়েক স্থানে তাদের আবারো টাকা দিতে হয়। গরু ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, গত রোববার গরু নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে টাঙ্গাইল বাইপাসে ১ হাজার চারশ` টাকা দিয়েছেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চাঁদার টাকা আদায়ের জন্য শুধু বগুড়া জেলার ১৫টি পয়েন্টে ১০০ বেশি কলার বয় (চাঁদার টাকা উত্তোলনকারী) নিয়োগ করা হয়েছে। এরা দিন ১০০ থেকে ৩০০ টাকার চুক্তিতে চাঁদার টাকা আদায় করে দেয়।
ভুক্তভোগী ট্রাকচালকদের তথ্যমতে চাঁদা উঠছে বগুড়ার মোকামতলা, মহাস্থানগড়, মাটিডালির মোড়, চারমাথা বাসস্ট্যান্ড, ভবেরবাজার, তিনমাথা রেলগেট, শাকপালা, বনানী, লিচুতলা, শাহজাহানপুর, শেরপুর, মানিকচক, সাবগ্রাম, চান্দাইকোনা, গোদারপাড়ায়। এসব স্থানে বাইরের জেলার গাড়ি থেকে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন রাজশাহী শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল লতিফ মন্ডল জানান, মোটর শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডের জন্য প্রতিটি জেলায় ৩০ থেকে ৫০ টাকা আদায় করা হয়। এটা বৈধ চাঁদা। কিন্তু ট্রাক শ্রমিকরা পুলিশকে ম্যানেজ করে যে চাঁদা তুলছে সেটা পুরোপুরি অবৈধ। এরা ট্রাকচালককে জিম্মি করে চাঁদা নিচ্ছে।
এদিকে গত শুক্রবার রাতে বগুড়ায় কোরবানির গরুর ট্রাক থামিয়ে ব্যবসায়ীরদের কাছে চাঁদাদাবি করার সময় র্যাব-১২ ক্যাম্পের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ২ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলো, বগুড়া সদরের চেলোপাড়ার জাকিরুল ইসলামের ছেলে আসাদুজ্জামান নুর অনন্ত (২৫) ও বগুড়া সদরের সূত্রাপুরের মৃত আমজাদ হোসেনের পুত্র মাহমুদ হাসান (৩৮)। এরা রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকাগামী গরুর ট্রাক বগুড়া শহরের সাতমাথায় থামিয়ে গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছিল।
এমএএস/আরআইপি