কীভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:১৭ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯
গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরা থেকে ‘ফার্স্ট হিটলার বস’ (এফএইচবি) নামক কিশোর গ্যাং গ্রুপের ১৪ জনকে অস্ত্রসহ আটক করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)

ঢাকার একজন বাসিন্দা ইব্রাহিম হোসেন লক্ষ্য করছিলেন যে, তার ছেলেটির আচরণ সম্প্রতি বেশ বদলে গেছে। তিনি তার ছেলে সম্পর্কে বলেন, ‘সে ঠিক সময়ে বাসায় ফেরে না। স্কুল শেষ করেও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চলে যায়, আসে অনেক রাতে। ওর মায়ের কাছে বেশি হাতখরচের টাকার জন্য বায়না করে।’

‘আমি ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, বাসায় সময় কত দিতে পারি? কিন্তু স্কুল থেকে অভিযোগ আসার পরে সেখানে গিয়ে জানতে পারি, আরও কয়েকজন ছেলের সঙ্গে মিলে অন্য একজনকে মারধর করেছে। এটা জেনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।’

ফরিদপুরের একজন বাসিন্দা গত ১০ বছর ধরে সৌদি আরবে চাকরি করেন। গ্রামের বাড়িতে স্ত্রী-দুই সন্তান থাকে। কিছুদিন আগে স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি মোটরসাইকেল কেনার জন্য কান্নাকাটি শুরু করলে, স্ত্রীর চাপে তিনি সেটি কেনার জন্য টাকাও পাঠান।

কয়েকদিন পরে সেই মোটরসাইকেল নিয়ে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ছিনতাই করতে গিয়ে, পুলিশের হাতে আটক হয় সে। মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়, এখন জামিন হলেও মামলা চলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার স্ত্রী বলছিলেন, ‘ছেলে যখন যা চেয়েছে, সব কিনে দিয়েছি। কোনো বায়না বাকি রাখি নাই। কিন্তু সে যে এই কাজ করবে কল্পনাও করি নাই। অন্য খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে সে নষ্ট হয়েছে।’

বাংলাদেশে ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় কিশোরদের মধ্যে গ্যাং বা দলবদ্ধভাবে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

গত ৮ সেপ্টেম্বর পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারী কিশোর গ্যাং কালচার যেন গড়ে উঠতে না পারে, সে ব্যাপারে পুলিশ সুপারদের তৎপর থাকার জন্য নির্দেশ দেন।

ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় এ ধরনের কিশোর গ্যাংয়ের কারণে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া মারধর, চুরি, ছিনতাই, ইভ টিজিং, মাদক ব্যবসা, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মতো অভিযোগও রয়েছে এসব গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে।

সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা বলছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য রোধে কাজ করছে পুলিশ। আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি।

গত কয়েকদিন ঢাকা চট্টগ্রাম মিলিয়ে সারা দেশে এরকম কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অন্তত ১০০ কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব গ্যাং সদস্যদের মধ্যে অনেক নামীদামি স্কুলের শিক্ষার্থী, ধনী ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তানরাও জড়িয়ে পড়েছে। অথচ সন্তানদের এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে অভিভাবকদের কোনো ধারণাই ছিল না।

gange

কিশোর গ্যাং কালচার প্রতিরোধে ১০ সেপ্টেম্বর শুদ্ধি অভিযান শুরু করে পিরোজপুর জেলা পুলিশ। সেদিন রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত জেলার প্রতিটি থানায় অভিযান চালিয়ে স্কুল-কলেজপড়ুয়া ৯২ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ

কেন গ্যাং সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা?

পুলিশ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, অ্যাডভেঞ্চার বা ক্ষমতা দেখানোর লোভ, মাদক, বন্ধুদের পাল্লা পড়াসহ নানা কারণে কিশোর গ্যাংগুলো তৈরি হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তানিয়া রহমান বলেছেন, বর্তমান সময়ের ব্যস্ততার কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানদের ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। এমনকি সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, তাদের চাহিদা কী, এসব সম্পর্কেও তারা কোনো খোঁজ রাখেন না।

‘ফলে এই সন্তানরা বন্ধুদের কাছে আশ্রয় খোঁজে, তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করে। সেখানে তারা একই ধরনের মানসিকতা খুঁজে পায়, সাপোর্ট পায়। এভাবেই তাদের ছোট ছোট দল তৈরি হয়।’

তিনি জানান, পরে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে বা রাজনৈতিক বড়ভাইয়ের স্বার্থে এই কিশোররা জড়িত হতে থাকে। অনেক সময় এলাকায় আধিপত্য দেখানো, সবার সামনে নিজেকে জাহির করার লোভ থেকে তারা নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়ে।

‘দেখা যায়, ক্লাসের একজন বন্ধু কোনো গ্যাংয়ের সদস্য হলে আরেকজনকে সেখানে সদস্য হতে প্রভাবিত করে। এ ধরনের ছেলেদের অন্যরা একটু ভয় পায়। ফলে সেটা তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতার মনোভাব তৈরি হয়। তাই তারা গ্যাংয়ের সঙ্গে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে পড়ে।’

‘পরে মাদক বা নিজেদের খরচ জোগাড় করতে তারা নানা অপরাধ করা শুরু করে। এরপর আর বেরিয়ে আসতে পারে না’,- বলেন অধ্যাপক তানিয়া রহমান।

অনেক সময় নিজেদের দল ভারি করতে প্রথম দিকে বিনামূল্যে মাদক সরবরাহ করে শিক্ষার্থীদের আসক্ত করে তোলা হয়। পরে তাদের গ্যাংয়ের সদস্য করে নেয়া হয়।

তিনি সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বলেন, তার পরিচিত একটি পরিবারের সন্তান ঢাকার একটি নামী স্কুলের ছাত্র, কিন্তু কয়েকদিন ধরে স্কুলে যেতে চাইছিল না।

তার বাবা-মা জোর করার পর সে জানায়, সে আর ওই স্কুলে পড়তে চায় না। কারণ, সেখানে ওপরের ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র তাকে জোর করে মাদক নিতে বলে। না হলে তাকে মারধর করা হবে বলে হুমকি দিচ্ছে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা বলেন, তারাও এ ধরনের ঘটনা শুনেছেন, কিন্তু তারাও অসহায়। পরে ওই স্কুলটি পরিবর্তন করে ওই পরিবারটি।

বিবিসি বাংলার কথা হয় এমন একজন তরুণের সঙ্গে যে স্কুলে পড়ার সময় ঢাকার একটি এলাকার একটি গ্যাংয়ের সদস্য ছিলেন। বর্তমানে একটি কলেজে পড়াশোনা করছেন। কেন তিনি এমন একটি গ্রুপে জড়িত হয়েছিলেন?

‘ক্লাসের তিনটা গ্রুপ ছিল। বেশিরভাগই কোনো না কোনো গ্রুপের সদস্য ছিল। ওদের সঙ্গে থাকলে সবাই সমীহ করতো। কারো সঙ্গে গণ্ডগোল হলে ওরা আমার হয়ে মারপিট করতে আসতো, সে কারণে বেশ ক্ষমতাবান মনে হতো। আমিও কয়েকবার অন্যদের সঙ্গে মারামারি করেছি।’

কিন্তু একসময় এই গ্রুপের সদস্যরা মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ে, যাার শিকার হন তিনিও। পরিবারের সদস্যরা টের পেয়ে রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করে সুস্থ করে তোলেন। পরে তার পরিবার ওই এলাকা বদলে আরেক এলাকার স্কুলে তাকে ভর্তি করান।

‘তখন যদি আমার পরিবার আমাকে ফিরিয়ে না আনতো, আজকে হয়তো আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতো’,- বলেন সদ্য কুড়ি উত্তীর্ণ তরুণটি।

কীভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান গ্যাং কালচারে জড়িত

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোরদের গ্যাংয়ে জড়িত হওয়া ঠেকাতে অভিভাবকরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন।

অধ্যাপক তানিয়া রহমান বলেছেন, সন্তানের চলাফেরা, আচরণের দিকে লক্ষ্য রাখলেই বুঝতে পারা যাবে যে, সে আসলে কোনো গ্যাং বা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কি না।
‘হয়তো সন্তানটি সময়মতো বাসায় ফিরছে না। ঠিকমতো খাচ্ছে না বা ঘুমাচ্ছে না। হয়তো বাসায় ফিরে নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকছে। অতিরিক্ত টাকা দাবি করছে। বাসায় বন্ধুদের নিয়ে বেশি আড্ডা দিচ্ছে। ‘

‘কাপড়চোপড়ের ধরণ পাল্টে যাচ্ছে। হয়তো হাতে বা কানে নানা ধরনের অলংকার ব্যবহার শুরু করেছে। কথাবার্তা বা আচরণে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এসব লক্ষণ দেখা গেলেই সন্তানের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে,’ বলেছেন অধ্যাপক তানিয়া রহমান।

তিনি বলেন, বর্তমানে অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনেই কাজ করেন, ফলে সন্তান কী করে, কার সঙ্গে মেশে, সেটা ঠিকভাবে খোঁজ রাখেন না। কিন্তু সন্তানের ওপর সবসময়ে নজর রাখা খুব জরুরি। বিশেষ করে কাদের সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, টাকা কোথায় খরচ করছে, ঠিক সময়ে বাসায় ফিরছে কি না, ইত্যাদি নজরে রাখা উচিত।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক (মনোরোগ) মেখলা সরকার বলেন, ‘সন্তানের আচরণের দিকে লক্ষ্য রাখলেই বোঝা সম্ভব যে, তার মধ্যে আসলে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কি না? সে কোনো গ্যাং বা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কি না? কারণ, এ রকম কিছু ঘটলে তার আচরণে, অভ্যাসে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে। প্রথম দিকে সেটা শনাক্ত করা গেলে খুব সহজেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।’

তিনি বলেন, এ রকম ঘটনায় ছেলেমেয়ের টাকার চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে তার বাসায় ফেরার সময়সূচিরও ঠিক থাকে না। এই দুইটি বিষয় দেখা গেলেই সতর্ক হওয়া উচিত।

কীভাবে ফেরাবেন সন্তানকে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তান গ্যাংয়ের সদস্য জানতে পারলেই আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। বরং পারিবারিক কিছু উদ্যোগের মাধ্যমেই এ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক তানিয়া রহমান বলেন, ‘অভিভাবকদের জন্য সন্তানকে সময় দেয়া জরুরি। তাদের সঙ্গে আস্থার, বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।

‘আমাদের সংস্কৃতিতে পশ্চিমা অনেক কিছু ঢুকে গেছে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছি, বিদেশি কেতায় চলছি, সুতরাং সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই স্বাভাবিকতা নিয়ে আসতে হবে। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করাটা জরুরি।’

তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, সন্তানের স্কুলে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা, কাদের সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, সেটা নিয়মিতভাবে নজরে রাখা উচিত।

এ ছাড়া সন্তানদের হাতখরচ দেয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকা উচিত, যেন সেটা অতিরিক্ত না হয়।

মনোরোগবিদ অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, ‘সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে হবে। তাকে বকাঝকা নয়, বরং তার কথা শুনতে হবে। কেন সে গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত হয়েছে, সেটা বোঝা দরকার। সন্তানের চাহিদার ব্যাপারটি বুঝতে হবে।’

তিনি বলেন, অনেক পরিবারে বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব থাকে। আমরা দেখেছি, এ ধরনের পরিবারের সন্তানরাই মাদক বা গ্যাং জাতীয় ঘটনাগুলোয় বেশি জড়িয়ে পড়ে। সেই দূরত্ব কাটাতে অভিভাবকদেরই উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, অনেক বাচ্চার মধ্যে আচরণগত ক্রুটি থাকে। এ কারণেও অনেকে গ্যাংয়ের সদস্য হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তা নিতে হবে।

তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, এরকম ঘটনায় সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে পরিবেশের পরিবর্তন। যেমন ওই এলাকা থেকে দূরের অন্য এলাকায় চলে যাওয়া, স্কুল-কলেজ বদলে ফেলা ভালো। সেক্ষেত্রে সন্তানের জন্য সমস্যাটি কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

জেডএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।