বাংলাদেশ যেন ঘৃণামূলক বক্তব্যের শিকার না হয় : মিয়া সেপ্পো
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট অত্যন্ত জটিল। এর সমাধানগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ এ সংকট খুবই দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। এজন্য বাংলাদেশ প্রশংসার দাবিদার।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট : টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে’- শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, অ্যাকশন এইড ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড স্টাডিজ যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
মিয়া সেপ্পো বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পাশাপাশি আমাদের এটাও নিশ্চিত করতে হবে, বাংলাদেশ যাতে কোনো ঘৃণামূলক বক্তব্যের শিকার না হয়। টেকসইমূলক সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরে শান্তিতে জীবন-যাপন করতে চান বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে পাঁচ দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এছাড়া বক্তব্য দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (এশিয়া প্যাসিফিক) মাহবুব উজ জামান, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কে এম আব্দুস সালাম, ঢাকায় নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত বেনোয়েট প্রিফন্টেইন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মানজুর হাসান, অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির প্রমুখ।
নিরাপদ প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের আইনে পরিবর্তন আনতে হবে
বাংলাদেশ প্রথম সারিতে থেকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা করছে উল্লেখ করে কানাডিয়ান হাইকমিশনার বেনয়েট প্রিফনটেইন বলেন, নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে মিয়ানমারের আইনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে জবাবদিহিতা।
রোহিঙ্গাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার ওপরও জোর দেন তিনি। বেনয়েট প্রিফনটেইন আরও বলেন, কানাডা এ সমস্যার টেকসই সমাধান চায়। তবে এ সমাধান খুব সহজ হবে না।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যের সব সম্প্রদায় যাতে নিরাপদে থাকতে পারে এবং প্রাথমিক পরিষেবা ও জীবিকার সুযোগ-সুবিধা পায় তা মিয়ানমার সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, কোনো আইনগত অধিকার ও জীবনের নিরাপত্তা ছাড়া প্রত্যাবাসন কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সেই বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এ ধরনের সহিংসতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকেই যাবে।
আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রথম পর্যায়ে ‘দি রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্রাইসিস : টুওয়ার্ডস সাসটেইনেবল সল্যুশন’ বিষয়ক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। ২০১৮ সালের এপ্রিলে আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট : টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রবন্ধসমূহের সংকলন এ বই।
অনুষ্ঠানের ধারণাপত্রে বলা হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে জরুরি অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা যেমন- খাদ্য, পুষ্টি, আশ্রয়, পানি, স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা এবং মনোসামাজিক-সহ বৃহৎ পরিসরে মানবিক সাড়া প্রদান করছে। গণ-অনুপ্রবেশের দুই বছর পর বর্তমানে এ সংকট জরুরি অবস্থা থেকে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। সেই সঙ্গে কাজ করছে নানা ধরনের বিষয়, যেমন- স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি, জাতীয় অর্থনীতিতে চাপ, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক বিষয়বস্তু এবং প্রত্যাবাসনের জটিলতাসমূহ, বহু-মাত্রিক সংকটের আবির্ভাব এবং বিশেষ করে সমাধানের চ্যালেঞ্জসমূহ।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ড. সৈয়দ রিফাত আহমেদ বলেন, যখন প্রথম গণ-অনুপ্রবেশ শুরু হয় তখন বাংলাদেশ জরুরি সাড়া প্রদান করে। তবে এ বহুমাত্রিক সংকট নিরসনে মূল দায়িত্ব মিয়ানমারকেই পালন করতে হবে। কিন্তু তার নিশ্চয়তা পাওয়া খুবই কঠিন। তাই এখনই সময় বস্তুগত সাহায্য ছাড়াও টেকসই সমাধানের দিকে জোর দেয়ার।
আন্তর্জাতিক আইনে বিদ্যমান উপায়সমূহ চিহ্নিত করে সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানান বিচারপতি রিফাত আহমেদ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস এন্ড জাস্টিজ-এর নির্বাহী পরিচালক এবং অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের চেয়ারপারসন মঞ্জুর হাসান বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি জানাতে হবে। মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জোর দিতে হবে। এছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে।
দুই বছর আগে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা নারী, মেয়ে-ছেলে ও পুরুষ মিয়ানমার থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
মানবিক সহায়তাকারী সম্প্রদায়, বাংলাদেশ সরকার এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী একত্রে এ সংকট মোকাবিলা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সকলের সহযোগিতায় যদিও রোহিঙ্গাদের উন্নতি সাধন হয়েছে তবে মানবিক সহায়তার জন্য এখনও তহবিলের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রহীন শরণার্থী দল।
জেপি/এমএআর/জেআইএম