শিক্ষা খাতের বরাদ্দ হতাশাব্যঞ্জক : আরেফিন সিদ্দিক


প্রকাশিত: ১০:২৮ পিএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

‘উচ্চশিক্ষা নির্ভর করে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রাষ্ট্র সেই অর্থে গুরুত্ব দিতে পারেনি। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা দিনকে দিন অবহেলায় পড়ছে। এটি হতাশার কারণ।’ - বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। উচ্চশিক্ষা, শিক্ষা ব্যয় ও মান নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু

জাগো নিউজ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন কিভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন?

আরেফিন সিদ্দিক : শিক্ষা পণ্য নয়। এটি সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। পণ্যের সঙ্গে ভ্যাট সংযুক্ত করা যায়, তাই বলে শিক্ষাতেও। শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থে যেকোনো আন্দোলনে আমরা নৈতিক সমর্থন করি। এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকারের সিদ্ধান্তকেও সাধুবাদ জানাই।

জাগো নিউজ : অষ্টম বেতন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বনির্ভর হতে বলা হয়েছে, -এ নিয়ে আপনার অভিমত কি?

আরেফিন সিদ্দিক : আমি মনে করি সপ্তম বেতন কাঠামোয় শিক্ষকদের জন্য যা নির্ধারিত ছিল, অষ্টম বেতন কাঠামোতেও সেই অনুপাত অনুসরণ করা উচিত। বেতন বৃদ্ধির সেই অনুপাত থাকলেই বিতর্ক অনেকটা নিরসন হবে। শিক্ষকরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে। আমি মনে করি অন্তত আগের বেতন কাঠামো অনুসরণ করে শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে।

জাগো নিউজ : সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আয় বাড়াতে বলছে, এ বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

আরেফিন সিদ্দিক : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখতে হবে, জাতি গঠনের প্রধান নিয়ামক হচ্ছে শিক্ষা। দেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। আর শিক্ষা ব্যবস্থার নেতৃত্বের জন্য মেধার কোনো বিকল্প নেই। দেশে অনেক মেধাবী আছে, যারা অর্থের অভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি আত্মনির্ভরশীলতার নামে বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেয় তাহলে গরিব মেধাবীরা আর উচ্চশিক্ষা নিতে পারবে না।

জাগো নিউজ : আপনি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের অভিভাবক, সরকারের পক্ষ থেকে বেতন বাড়ানোর চাপ অনুভব করছেন?

আরেফিন সিদ্দিক : চাপ থাকতেই পারে। যৌক্তিক জায়গা থেকে আমাদেরও তা মোকাবেলা করতে হবে। আমি মনে করি, ন্যূনতম টিউশন ফি দিয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের দ্বার আরো বহুদিন উন্মুক্ত রাখতে হবে। এই জায়গা থেকে চাপ মোকাবেলা আমাদের করতেই হবে। কোনোভাবেই মেধাবীদের উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

জাগো নিউজ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে। গরিব মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে কি-না?  

আরেফিন সিদ্দিক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ টিউশন ফি দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে, তাতে সেখানে গরিবদের কোনো ঠাঁই নেই। এখন পর্যন্ত গরিব মেধাবীদের ভরসাস্থল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণেই মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চরিত্র পাল্টানো ঠিক হবে না।

জাগো নিউজ : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তো এখন অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দান করছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই বিভিন্ন কোর্স চালু করা হচ্ছে, যেখানে উচ্চ বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে - এ বিষয়ে আপনার অভিমত?  

আরেফিন সিদ্দিক : আমি তা মনে করি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কোনো কোর্স চালু হয়নি। সান্ধ্য কোর্স, নাইট কোর্স বা এক্সিকিউটিভ নামের যে কোর্সগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তা বেশিরভাগই পেশাজীবীদের জন্য। এই ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চেয়ে তাদের কাছ থেকে কিছুটা বেতন বেশি নেয়া হচ্ছে এবং সেটা খুবই যৌক্তিক।

জাগো নিউজ : অভিযোগ আছে এসব কোর্স নিয়ে শিক্ষকরা অতি ব্যস্ত থাকছেন। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঠকছে কি-না?

আরেফিন সিদ্দিক : না, শিক্ষকরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেবার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। সেবার শতকরা ৮০ ভাগই সাধারণের জন্য। অতিরিক্ত সময় ও মেধা খাটিয়েই এসব কোর্সের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। দেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিতে হলে উচ্চশিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তার নিজস্ব দায় থেকেই এই কাজটি করতে হবে।
 
জাগো নিউজ : এই সুবিধা কতিপয় বিভাগের শিক্ষকরা পাচ্ছেন। বিশেষত বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষকরা এসব কোর্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছেন। অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে কি-না? 

আরেফিন সিদ্দিক : বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তা বলা যাবে না। বিষয়টি হচ্ছে সুযোগের। সারা দুনিয়া কর্পোরেটের দিকে ঝুঁকছে। আমাদের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা বেশিরভাগ একটি অংশ বাণিজ্য অনুষদে পড়তে চাইছে। এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বুয়েট, মেডিকেলের শিক্ষার্থীরাও বিবিএ, এমবিএ করতে চাইছে। পেশাজীবীরাও তাই করে আসছে। এই কারণেই বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষকরা সম্পৃক্ত হতে পারছেন।

জাগো নিউজ : শিক্ষার আনুপাতিক হার বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে -এ বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?  

আরেফিন সিদ্দিক : শিক্ষার হার বাড়ছে, পরিসংখ্যানও তাই বলে। তবে মান বাড়ছে না, আমি তা বলবো না। বাংলাদেশের শিক্ষার মানও বাড়ছে। দেশ তো এগিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ব শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করে আমাদের অবস্থান কোথায়? গোটা পৃথিবী এখন বিশ্বগ্রাম। মুহূর্তের মধ্যে মানুষ আমেরিকা-ইউরোপের শিক্ষা ব্যবস্থার খবর নিতে পারছে। সেখান থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। এটিই হচ্ছে আমাদের হতাশার কারণ।

জাগো নিউজ : উচ্চতর শিক্ষার অন্যতম খাত গবেষণা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে। প্রশ্ন ওঠছে গবেষণায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আগ্রহ এবং ফলাফল নিয়েও।  

আরেফিন সিদ্দিক : গবেষণা খাত অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়া এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আগ্রহ না থাকার প্রধানতম কারণ হচ্ছে গবেষণা খাতে সরকারের বাজেট না বাড়ানো। অনেক ভালো গবেষক আছেন, যারা ফান্ডের অভাবে গবেষণা কাজ চালাতে পারছেন না। গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে এটি যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য হচ্ছে এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগের অভাব আছে।

জাগো নিউজ : তার মানে এমন সময়েও শিক্ষা খাতের বরাদ্দ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে?

আরেফিন সিদ্দিক : শিক্ষা খাতের বরাদ্দ অবশ্যই হতাশাব্যঞ্জক। শিক্ষা খাতের তিনটি স্তর নিয়েই আমাদের কথা বলতে হবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলবো না, তা নয়। উচ্চশিক্ষা নির্ভর-ই করে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রাষ্ট্র সেই অর্থে গুরুত্ব দিতে পারেনি। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা দিনকে দিন অবহেলায় পড়ছে। এটি হতাশার কারণ।

প্রাথমিক শিক্ষকদের যে বেতন-ভাতা দেয়া হয়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী সেখানে শিক্ষকতা করতে চাইবে না। একান্ত বিপদে না পড়লে বা কোথাও চাকরি না হলেই এসব শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকতা করে থাকেন। একজন কম মেধাবী শিক্ষক দিয়ে আপনি জাতির ভিত দাঁড় করাতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবীকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পেতে হলে বেতন-ভাতা অনেক গুণ বাড়াতে হবে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাকে মানসম্পন্ন করতে না পারলে উচ্চশিক্ষাকে কখনো মানসম্পন্ন করা যাবে না। উচ্চশিক্ষার কাঁচামাল-ই হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু কুদরাত-ই খুদাকে দিয়ে যে শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন, তার রিপোর্ট ছিল একবারে বাস্তবমুখী। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ওই রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি।

ওই রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে, প্রজাতন্ত্রের শিক্ষা খাতের বরাদ্দের শতকরা ৬৫ ভাগ দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা খাতে। ২০ শতাংশ দিতে হবে মাধ্যমিক শিক্ষায় এবং ১৫ শতাংশ দিতে হবে উচ্চশিক্ষায়। এই অনুপাতে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করা হলে শিক্ষার মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠতো না। প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়লে ভিত এমনিতেই দাঁড়িয়ে যাবে।

এসএসএস/বিএ/আরএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।