‘সবাই নেতা, হেল্লাই সরে না প্লাস্টিকের কারখানা’

জসীম উদ্দীন
জসীম উদ্দীন জসীম উদ্দীন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:১১ পিএম, ১৬ আগস্ট ২০১৯

‘এইহানে একটা না দুইডা না, আরও ৩০-ডার মতো প্লাস্টিক কারখানা আছে। আমগোর চামড়ার ব্যবসা এখান থেকে সরানোর লাই কত কথা। কিন্তু প্লাস্টিক কারখানা তো সরানো গেলে না। কারখানা সরানো গেলে কি বারবার আগুন লাগে? এর আগেও এই পোস্তায় প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগছে। আমার বাড়ির ছাদ পুড়ছে, প্রতিবাদ করছি, আপত্তি জানাইছি। মাগার কাম হয় নাইক্কা। সবাই নেতা, সবারই প্রভাব। হেল্লাই সরে না প্লাস্টিকের কারখানা।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন লালবাগ পোস্তা এলাকার বাসিন্দা ও চামড়া ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান। আজ শুক্রবার (১৬ আগস্ট) দুপুরে প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এসব বলেন তিনি।

গত বুধবার (১৪ আগস্ট) রাতে রাজধানীর লালবাগের ইসলামবাগ এলাকার পোস্তা ঢালের ওয়াটার অক্সফোর্ড রোডে আগুনে পুড়ে যাওয়া ‘টিপু হাজী’ নামের প্লাস্টিক কারখানার লাগোয়া ভবনটি ফজলুল রহমানের। নিজের চোখে দেখেছেন আগুনের ভয়াবহতা।

তিনি বললেন, ‘এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এর আগে চুরিহাট্টার আগুনের পর প্রতিবাদ করা হয়েছে। কারখানা পরিচালনায় আপত্তির কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু লালবাগের আবাসিক এলাকা থেকে প্লাস্টিকের কারখানা সরানো যায়নি।’

তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতের আগুনে বারবার মনে হইতাছিল, এই বুঝি আমার ঘরেও লাগব। সে এক ভয়াবহ অগ্নি-পরিস্থিতির মধ্যে গেছে রাতটা। ভাগ্য ভালা ছিল হেল্লাই বাঁইচ্চা গেছি গা।’

শুধু ফজলুর রহমান নয়, রাজধানীর লালবাগ আবাসিক এলাকায় প্লাস্টিকসহ সকল ধরনের দাহ্য পদার্থের কারখানা সরানোর জন্য প্রতিবাদ করলেও তা সরানো যায়নি।

লালবাগের পোস্তার ঢাল এলাকায় আগুনে পুড়ে যাওয়া ওই ভবনটির আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, আগুন জ্বলে, ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভায়। এরপর কিছুদিন তোড়জোড় চলে। এরপর আবার অদৃশ্য কারণে সব বন্ধ হয়ে যায়। আবার চলা শুরু করে আগের মতোই। এর পেছনে সরকারদলীয় কিছু লোকের প্রভাব রয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজার চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নিহত আর আহত হয় শতাধিক মানুষ। এরপর আরও ৩টি ছোট-মাঝারি আগুনের ঘটনা ঘটেছে লালবাগে। সর্বশেষ ওই প্লাস্টিক কারখানায় আগুনের সূত্রপাত ঘটে।

ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ওই কারখানাটি যদি চালু অবস্থায় থাকত তাহলে হতাহত হওয়ার সম্ভবনা ছিল। কারণ এই কারখানাতেও চুরিহাট্টার মতো প্লাস্টিক তৈরির উপাদান ছিল। যা আগুনে জ্বলে ও আগুনের ভয়াবহতা বাড়ায়।’

ওই কারখানাটিতে প্লাস্টিকের জুতা, প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি হতো। ওপরে ছিল গোডাউন, নিচে কারখানা। গত বুধবার রাতের আগুনে দুই তলা ভবনটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।

শুক্রবার অগ্নিকাণ্ডের এলাকাটি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আবাসিক এলাকা হলেও গলিপথ খুবই ছোট। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার মতো স্পেস নেই। নেই পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও। চোখে পড়েনি একটা ফায়ার হাইড্রেন্টও (অগ্নিনির্বাপণকাজে ব্যবহৃত বিশেষ পানিকল)।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুড়ে যাওয়া ভবনটি থেকে তিন ভবন পরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমি নিজেও এই এলাকায় ব্যবসা করি। কিন্তু আমার এখানে কারখানা-গুদাম তৈরি, পরিচালনায় জোর আপত্তি আছে। কারণ আমরাই এখানে থাকি। আমাদেরও বাচ্চারা এখানে বেড়ে ওঠে। প্লাস্টিকের একটি কারখানা পুড়ল। কিন্তু এখানে আরও ৩০-৩৫টি প্লাস্টিকসহ অন্যান্য কারখানা আছে। দাহ্য পদার্থও রয়েছে। তাহলে এইভাবেই ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করতে থাকব আমরা?’

একই এলাকার আরেক ব্যবসায়ী বাসিন্দা সোবহান মিয়া বলেন, ‘আজ আগুনে একটি কারখানা পুড়ল। কাল হয়তো অন্য কোথাও লাগবে। এই লাগার পরেই আবাসিক এলাকা থেকে কারখানা উঠিয়ে দেয়ার তোড়জোড় করে সিটি কর্পোরেশন। এরপর কয়েকদিন বাদেই সব গুটিয়ে যায়। ফের আগুন লাগে ফের তোড়জোড় শুরু হয়। নিমতলী থেকে চুরিহাট্টা এই দেখে আসছি আমরা। এখানেই ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের প্রতিবাদে কোনো কাজ হয়নি। এই আগুনই প্রমাণ করেছে যে এখানে কারখানা আছে।’

পুড়ে যাওয়া ভবনটির সামনে পেছনে ঘুরে দেখা যায়, সামনে তিনটি বড় বড় ট্রান্সফরমার লাগানো। পেছনেও ট্রান্সফরমার। সাধারণত যতটা ওপরে বসানো থাকে ট্রান্সফরমার তার চেয়ে অনেক নিচেই খাটো খুঁটিতে বসানো হয়েছে।

পুড়ে যাওয়া কারখানাটির মালিক বশির আহমদের বোন আয়শা আক্তার মালা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভবনটির নিচের পড়ে থাকা প্লাস্টিকের স্তূপসহ আগুনের ধ্বংসাবশেষও সরিয়ে নিতে বলেছে ফায়ার সার্ভিস। ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভবনটি ভাঙতে বলেছে সিটি কর্পোরেশন। আজ সেটা শুরু করা হয়েছে। আগুনের কারণে তিন কোটি টাকার মতো মালামাল ও মেশিন পুড়ে গেছে। টেনশনে মালিক বশির ভাই এখন শয্যাশায়ী। হাসপাতালে ভর্তি।’

গত বুধবার (১৪ আগস্ট) রাত পৌনে ১১টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগের ওই প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। পরে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৬টি ইউনিটের সোয়া ২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভানো হয়।

ওই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন) দীলিপ কুমার ঘোষকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটির বাকি দুই সদস্য হচ্ছেন, ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (এডি) আব্দুল হালিম এবং উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) নিউটন দাস। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

জেইউ/এসআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।