ডুবেছে ঘর-বাড়ি : ট্রেনের বগিই শেষ ভরসা
আবু সালেহ সায়াদাত আবু সালেহ সায়াদাত , নিজস্ব প্রতিবেদক গাইবান্ধা থেকে
প্রকাশিত: ০৯:৫১ পিএম, ২৮ জুলাই ২০১৯
গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া জংশন। জংশন থেকে কিছুটা সামনের দিকে বেশকিছু পরিত্যক্ত মালগাড়ির বগি। প্রথমে দেখে মনে হয়, মালবাহী ট্রেনের বগিতে যারা দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন তারা হয়তোবা ট্রেনেরই যাত্রী। মনে হতে পারে তারা অপেক্ষা করছেন কখন ট্রেন ছাড়বে।
কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখা গেল বগির ভেতরে অনে্কেই রান্না-বান্নায় ব্যস্ত। মা রান্না করছেন আর সন্তানরা তাকিয়ে আছে ভাতের হাঁড়ির দিকে। একটু পরপরই জিজ্ঞেস করছে, মা ভাত হতে কত দেরি? মালবাহী এসব ট্রেনের বগির বাইরে বেঁধে রাখা হয়েছে গরু-ছাগল। বগির ভেতরে বসে কেউ কেউ হাঁস-মুরগিকে খাবার দিচ্ছে।
এসব মালবাহী ট্রেনের বগিতে যারা আশ্রয় নিয়েছেন তারা বানভাসি মানুষ। আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের বাড়ি-ঘর। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, বন্যার পানিতে বিলীন হয়ে গেছে সব। কেউ কেউ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। ফলে সর্বস্বান্ত হয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই বগিতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন বানভাসি মানুষেরা।
এছাড়া অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে উঁচু বাঁধের ওপরে কেউবা খোলা আকাশের নিচে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির অপ্রতুলতা; সেই সঙ্গে গবাদিপশুর নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব- সব মিলিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
যারা বাধ্য হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ট্রেনের বগিতে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি স্যানিটেশন সমস্যা তো আছেই। অসহায় এসব মানুষ নিজেদের বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর বাধ্য হয়ে বগিতে আশ্রয় নিয়েছেন। অর্থ সংকটে চাল বা শুকনো খাবার পাওয়া তাদের কাছে অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। যাদের কিছুটা চাল সংগ্রহে ছিল তারাও শুকনো খড়ির অভাবে ঠিকমত রান্না করতে পারছে না। যারা রান্না করছে তারাও একবেলা রান্না করে তিনবেলা খাচ্ছে।
আরেকটু সামনে এগুতেই দেখা গেল সাজেদা খাতুন নামে একজন বগির ভেতরেই ভাত রান্না করছেন। পাশেই বসে আছে তার মেয়ে সিফাত। মেয়েটি স্থানীয় বোনারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। মাকে বলছে, ভাত হতে আর কত দেরি? এদিকে ভাতের সঙ্গে শুধু আলু ভর্তা আর শুকনো মরিচ ভাজতে ব্যস্ত মা সাজেদা খাতুন।
তিনি বলেন, হঠাৎ করেই সব শেষ হয়ে গেল। বন্যার পানি এসে ডুবে গেল বাড়ি। থাকার জায়গা নেই, এ অবস্থায় শুধু হাঁড়িপাতিল, চুলা আর চাল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। বাধ্য হয়েই এখানে আশ্রয় নিয়েছি। আমাদের মতো প্রায় ১০০ পরিবার এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। পানি কমতে শুরু করলে অনেকেই চলে যেতে শুরু করে।
পাশের বগিতে আশ্রয় নেয়া ইদ্রিস আলী। পেশায় দিনমজুর। তিনি বলেন, '৮৮ সালের পরে এমন বন্যা গাইবান্ধায় আমরা দেখিনি। এই বন্যায় আমার বাড়ি-ঘর সব ডুবে গেছে। দুই ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ট্রেনের বগিতে আশ্রয় নিয়েছি। দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা চলে আমাদের। কিন্তু এই বন্যায় কোনো কাজ পাচ্ছি না। সবাই পানিবন্দির যন্ত্রণায় আছে। কাজ নেই টাকাও নেই, তাই খেয়ে না খেয়ে চলছে দিন। বাড়ি ফিরেও যেতে পারছি না, কারণ বাড়ি এখনও পানির নিচে। এখানে খাওয়ার কষ্ট নিয়েই কোনোমতে টিকে আছি।
বানভাসি সাহেরা খাতুন বলেন, ট্রেনের বগিতে এসে ওঠেছি। একটি এনজিও থেকে টিউবওয়েল বসিয়ে দিলেও লেট্রিন একটাই। যে কারণে সবার খুব সমস্যা হচ্ছে। শুকনো খড়ির অভাবে মানুষের দেয়া শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে আছি। এই বন্যা আমাদের সবকিছু শেষ করে গেল।
প্রসঙ্গত, উজান থেকে নেমে আসা পানি ও প্রবল বৃষ্টিপাতে ব্রহ্মপুত্র এবং ঘাঘট নদীর পানিতে প্লাবিত হয়েছে গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকা। জেলার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল জলমগ্ন অবস্থায় ছিল। বর্তমানে পানি কিছুটা কমলেও এখনও অনেকের ঘর-বাড়িতে পানি রয়ে গেছে। পানিবন্দি এখনও অনেক মানুষ, যাদের রয়েছে খাদ্য সঙ্কট। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত বানভাসি লোকজন এখনও ঘরে ফিরে যেতে পারছে না। গবাদি পশুর খাদ্য সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং স্যানিটেশন সমস্যা রয়েছে। ফলে পানিবন্দি মানুষের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এখানে।
প্রতিবারের মতো এবারও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম। এই উদ্যোগে সার্বিক সহযোগিতা করছে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। গত শুক্রবার লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে জাগো নিউজ টিম।
নীলফামারী ও লালমনিরহাটে ত্রাণসহায়তা কার্যক্রমের পর শনিবার কুড়িগ্রাম জেলায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার গাইবান্ধা জেলায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সেই সঙ্গে আগামীকাল সিরাজগঞ্জ জেলার বন্যার্তের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে। বন্যার্তদের জন্য এবার প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগিতায় প্রায় ২৫ লাখ টাকার ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- চাল, ডাল, মুড়ি, পানি, বিস্কুট, স্যালাইনসহ নানা খাদ্য সামগ্রী।
এবারের ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম দলে রয়েছেন- জাগো নিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক জিয়াউল হক, সহকারী বার্তা সম্পাদক মাহাবুর আলম সোহাগ, ওয়েব ইনচার্জ হাসিবুল হাসান আশিক, নিজস্ব প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ফয়সাল খান ও নিজস্ব আলোকচিত্রী মাহবুব আলম।
এএস/এমআরএম/জেআইএম