তার স্নেহমাখা কথাগুলো ভুলতে পারি না
আওয়ামী লীগ দলীয় সংরক্ষিত সংসদ সদস্য রুশেমা বেগমের মৃত্যুতে আপ্লুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রুশেমা ইতিহাস বিকৃতকারীদের উচিত জবাব দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তার স্নেহমাখা কথাগুলো আমি ভুলতে পারি না। সংসদে তিনি যে বক্তৃতা করেছেন সেটা আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যারা মিথ্যাচার করছেন তাদের একটা উপযুক্ত জবাব। বেইমান, মোনাফেকদের উপযুক্ত জবাব। তাই সংসদ সদস্যদের বলব, তার বক্তৃতাটা সংগ্রহ করে পড়তে, শুনতে।
বুধবার বিকেলে সংসদে মরহুম সংসদ সদস্য রুশেমা বেগমের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। তার আগে সংসদ নেতাসহ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা আলোচনা করেন। আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ, বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা প্রমুখ।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) ফরিদপুরে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রুশেমা বেগম। এর আগে এ বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ থেকে সংরক্ষিত সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
রুশেমার স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। একটা যুগে মেয়েদের শিক্ষা অত্যন্ত কঠিন ছিল। সেই যুগে তিনি লেখাপড়া করেন, প্রথমে মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন, তিনি ইশান মেমোরিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তার স্বামী ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করতেন। আমরা যখন যেতাম উনার স্বামী পরিচয় করে দিতেন, আমাদের প্রধান শিক্ষিকা এসে গেছে। আমি উনার অধীনে চাকরি করি। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে একটা সমঝোতা চমৎকার পরিবেশ। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। খুব ধীরস্থির ভালো মনের মানুষ ছিলেন ‘
তিনি বলেন, ‘১৯৮১ সালে আমি যখন দেশে ফিরে আসি। পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়ে সেই স্বজন হারানো বেদনা নিয়েই ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু আমি ভালোবাসা পেয়েছিলাম, স্নেহ পেয়েছিলাম তাদের কাছ থেকে, যারা জাতির পিতার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছেন।’
এ কথাগুলো বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেকটা আপ্লুত হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘সারাদেশে যখন সফর করেছি আমরা সবসময় থাকতাম আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে। আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা পারিবারিক চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সব সময় নির্যাতিত ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ও তার স্বামী সক্রিয় ছিলেন। সেখানে তাদের অবদান রয়েছে। তারপর মার্শাল, সেখানেও তারা নির্যাতিত।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারো সংসারে যদি একজন জেলে যায় তখন তার সংসার চালানো এবং তার ছেলে-মেয়ে মানুষ করা সেটা যে কত দুরূহ একটা কাজ ছিল, সেটা তিনি করেছেন। ৬ দফা দেয়ার পর অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন তারা।’
‘তার স্বামী ইমাম উদ্দিন সাহেবকে খুব সক্রিয় পেয়েছিলাম। আসলে প্রকৃতপক্ষে উনি (রুশেমা) কখনো কিছু চাননি, উনি কোনো দিন আমাকে বলেননি, আমাকে এমপি করো বা কিছু করো। বরং নির্বাচন চলাকালীন আমি আর রেহানা ৫ নম্বরে গেছিলাম, উনি তখন আসেন। ফরিদপুরের নির্বাচন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করার জন্য। যেহেতু উনি প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন, অনেক ছাত্রী ছিল। উনি সব ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন, আমাদের পক্ষে যাতে ভোট আসে সেই ভোটের জন্য তিনি কাম্পেইন করতেন। সে সময় তিনি কিছু জরুরি কথা বলে যান।’
‘উনার সঙ্গে যখন আমি কথা বলি তখন রেহানা বলে, উনাকে সংরক্ষিত আসনের এমপি করতে হবে। তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, এটা করব। উনার জীবনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তার মাঝে কোনো অহমিকা ছিল না। আমি উনাকে বলেছিলাম, একটা ফরম নিয়ে পূরণ করেন। উনার ছেলেকে বলেছিলাম, একটা ফরম নিয়ে যাও মায়ের জন্য। প্রস্তাবটা নিয়ে আস। উনি জানতে পেরে খুব খুশি হয়েছিলেন’-যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংসদ নেতা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। প্রতিটি এলাকায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে গেরিলা যুদ্ধের রূপরেখা দিয়েছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। সেখানে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তার মধ্যে অন্যতম ইমাম উদ্দিন। স্বাধীনতার ঘোষণাটা পূর্বপরিকল্পিতভাবে তখনকার ইপিআর, এখনকার বিজিবি, পিলখানায় ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তিনি ওটা প্রচার করেন। এটা প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটা জেলায় জেলায় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা সেটা সংগ্রহ করে। সেদিন রুশেমা ইমাম যে বক্তব্য রাখলেন, সেখানে সেই ঘটনাটা তুলে ধরেছিলেন। আমি মনে করি স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে যারা অসত্য তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে, তাদের একটা উপযুক্ত জবাব এই সংসদে তুলে ধরেছেন। এরপর আর এই ব্যাপারে কারো কনফিউশন থাকার কথা নয়। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, তার স্বামী ইমাম উদ্দিন পুলিশের কাছ থেকে তথ্যটা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। ইতিহাসের একটা বিরাট সত্য জানতে পারলাম। এটা সংসদে রেকর্ড হয়ে থাকল যেটা যুগের যুগ রেকর্ড হয়ে থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী রুশেমা সম্পর্কে আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালে তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। সংসদে সেদিন বক্তৃতায় বলেছিলেন, স্বাধীনতা ঘোষণার সব কাগজপত্র তার কাছেই ছিল। আগুন দেয়ার পর সেগুলো সুরক্ষা করতে পারেননি।’
‘তিনি শিক্ষার ওপর অনেক পরামর্শ দিয়েছেন, আরও কথা বলতে চেয়েছেন। তার বক্তৃব্যটা মুগ্ধ হয়ে সবাই শুনছিলাম। কয়েকদিন আগে বললেন, আমি ঠিক গুছিয়ে তো বলতে পারলাম না। আমি বলেছিলাম, একটা ইতিহাস জানার সুযোগ হয়েছে, আপনি ভালো বলেছেন। বিশেষ করে যারা ইতিহাস বিকৃত করে যাচ্ছে তাদের জন্য একটা জবাব। বেইমান, মোনাফেকদের জবাব হয়েছে। আমাকে বলল, মা ভালো লেগেছে? উনার স্নেহমাখা কথা ভুলতে পারি না। তার কথাগুলো আর শোনা হলো না।’
এইচএস/এসআর/জেআইএম