শাহনীলা ফেরদৌস ও প্রফেসর ফারুক কি ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবেন?

বিশেষ সংবাদদাতা
বিশেষ সংবাদদাতা বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৮:৩৮ পিএম, ০৯ জুলাই ২০১৯

‘নিরাপদ তরল দুধ উৎপাদন : দেশীয় দুগ্ধশিল্প রক্ষা ও বিকাশে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে দুধ নিয়ে গবেষণা করা ড. শাহনীলা ফেরদৌস ও অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আলোচকরা। তারা ওই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও আহ্বান জানিয়েছেন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাণ, মিল্কভিটা, আড়ংসহ দুগ্ধ উৎপাদনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং দুধের বিষয়ে গবেষাণা করা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা আলোচনা সভায় অংশ নেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি সায়েন্স অনুষদের শিক্ষক প্রফেসর মো. নুরুল ইসলাম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন।

অধ্যাপক মো. নুরুল ইসলাম তার প্রবন্ধে বাংলাদেশের তরল দুধের উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাননিয়ন্ত্রণ ও বাজারজাতকরণের সামগ্রিক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি দেশে উৎপাদিত তরল দুধের গুণগতমানের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা গুঁড়ো দুধের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি নিরাপদ তরল দুধের উৎপাদন ও বিপণনের বিভিন্ন দিকও তুলে ধরেন। এসব বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করতে সংশ্লিষ্ট আলোচকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

আলোচকরা বলেন, ডেইরি খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অর্ধকোটি মানুষ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন।

তারা বলেন, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের অন্যতম একটি সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে দেশীয় ডেইরি শিল্প। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে মোট নয়টি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে এ খাত সরাসরি সম্পৃক্ত। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে এ দেশে ডেইরি শিল্প গড়ে উঠেছে। দেশে বর্তমানে এক লাখেরও বেশি নিবন্ধিত খামারি রয়েছেন। প্রায় অর্ধেকই উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক।

গত এক দশকে দেশে উৎপাদিত দুধের পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মোট চাহিদার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এখন দেশীয় উদ্যোক্তারা সরবরাহ করছেন। এ খাতকে আরও এগিয়ে নিয়ে দেশের আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক দুধ নিয়ে গবেষণা করা ড. শাহনীলা ফেরদৌস ও আ ব ম ফারুকের কথা উল্লেখ করে বলেন, এ দুজন গবেষক কেন দুধের গবেষণা করে এমন রিপোর্ট দিলেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমাদের কোথাও যদি কোনো ফল্ট থাকে আমরা তা নিয়ে আলোচনা করব। দুগ্ধ শিল্প নিয়ে যেন কোনো আতঙ্ক তৈরি না হয় সেদিকে নজর দেয়া আমাদের সবার কর্তব্য।

বিএলআরআই'র মহাপরিচালক ড. নাথুরাম সরকারও ওই দুই গবেষকের সমালোচনা করে বলেন, এসব গবেষকের হেদায়েতের প্রয়োজন। তাদের এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এলে ঠিকই তাদের হেদায়েত করতাম।

তিনি বলেন, যারা প্রফেশনাল নন, তারা কেন এ কাজ করতে যাবেন? সরকার কি তাদের দায়িত্ব দিয়েছে? কোন স্বার্থে, কার স্বার্থে তারা এ কাজ করলেন? তাদের প্রপাগান্ডার কারণে এ শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে তা কি পুষিয়ে দিতে পারবেন?

ড. মহিউদ্দিন বলেন, দুধের বিষয়ে যেকোনো ব্যক্তি বা বিশেষজ্ঞ যখন মিডিয়া বা সংবাদপত্রে কোনো মতামত দেবেন, তখন খামারিদের কথা, দেশের কথা চিন্তা করে মতামত দেবেন। তারা যেন দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে না দেন।

তিনি বলেন, আ ব ম ফারুকের কারণে গত কয়েক দিন দুধ বিক্রি কমে গেছে। দ্রুত এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে অনেক খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

ড. আশিকুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ করে যে কেউ যেকোনো বিষয়ে মিডিয়ার কাছে কোনো তথ্য দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা প্রকাশ করা উচিত নয়। যেকোনো রিপোর্ট প্রকাশ করার আগে ক্রসচেক করে প্রকাশ করা উচিত। তা না করলে দেশের ও জনগণের ক্ষতি হতে পারে।

তিনি বলেন, জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে এমন কাজ যারা করেন তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাতটি প্যাকেটজাত (পাস্তুরিত) দুধসহ ৭২টি খাদ্যপণ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে সাতটি ব্র্যান্ডের দুধে ক্ষতিকর মাত্রায় ব্যাকটেরিয়া ও কোনো কোনো দুধে ডিটারজেন্ট মেশানোর তথ্য প্রকাশ করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনটির নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক এবং ফার্মেসি অনুষদের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক।

ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার স্বাক্ষরিত প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ফলাফলের প্রতিবেদন ওই গবেষকের একান্ত নিজস্ব গবেষণালব্ধ ফল হওয়ায় উপরোক্ত গবেষণা ফলাফলের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগের কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকায় ফার্মেসি বিভাগ কোনো প্রকার দায়ভার গ্রহণ করছে না।

মঙ্গলবার প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ‘নিরাপদ তরল দুধ উৎপাদন : দেশীয় দুগ্ধ শিল্প রক্ষা ও বিকাশে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের ডেইরি শিল্পকে ধ্বংস করতে চক্রান্ত চলছে। একশ্রেণির শত্রু এ শিল্পের পেছনে লেগেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ কাজ করেছেন।

‘কোম্পানির সাত ধরনের পাস্তুরিত দুধের নমুনায় অ্যান্টিবায়োটিক এবং তিন ধরনের দুধে ডিটারজেন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে’ -গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়ার তথ্য প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। গত ২ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের লেকচার থিয়েটারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।

প্রফেসর ফারুকের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত সচিব বলেন, কোনো গবেষক কোনো বিষয়ে গবেষণা করলে এবং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করার বিষয়ে কিছু এথিক্স মেনে চলতে হয়। আপনি এথিক্স না মেনে যা করেছেন তা ভুল করেছেন। আপনার গবেষণার ফলাফল কি পিআর রিভিউ জার্নালে প্রকাশ করেছেন? তা না করে আপনি ভুল করেছেন। সাতদিনের মধ্যে জবাব না দিলে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি বলেন, প্রাইভেট সেক্টর যদি এগিয়ে না আসে তাহলে দুগ্ধ শিল্পের প্রসার ঘটবে না। সবাইকে প্রতিদিন দুধ খাওয়ার জন্য এবং স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য আহ্বান জানান তিনি। বলেন, দুধ জান্নাতের খাবার। কোনো ফার্মার চায় না তার দুধে ভেজাল থাকুক। একটা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে এ শিল্পকে যারা ধ্বংস করতে চান তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না।

এফএইচএস/এমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।