কে বলবে, মা আমাকে একটু আদর করো
‘আমার সোনা মা। সে আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। সবসময় আমার পাশেই থাকত। আমার বুকে এসে বলত, মা তুমি কী করো? আমাকে একটু আদর করে দাও। কোথাও থেকে আসলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরত। আজ সে নেই। শূন্য আমাদের ঘর। কে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে, মা আমাকে আদর করো। এখন তার ছবি আমাদের স্মৃতি। কী অপরাধ ছিল আমার সোনা মায়ের। তাকে কেন ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হলো? আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, আমার মেয়ের হত্যাকারীর যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি হতে না হয়।’
রাজধানীর ওয়ারীতে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার সিলভারডেল স্কুলের নার্সারির ছাত্রী আফরিন সায়মার (৭) মা সানজিদা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন। সায়মার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সায়মার মা সানজিদা আক্তার ও বাবা আব্দুস সালাম তাদের মেয়ের ছবি বুকে নিয়ে কাঁদছেন। তাদের কান্না দেখে আশপাশের অনেকেই কান্না থামাতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের আকুল আবেদন, সায়মার হত্যাকারীর যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। কোনোভাবেই যেন অপরাধীরা পার পেয়ে না যায়।
সায়মার মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আজ আমি একা হয়ে গেলাম। সে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরত সবসময়। আজ আমার বুক শূন্য হয়ে গেল। কী অপরাধ ছিল আমার মেয়ের।’
সায়মার বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ফুটফুটে মেয়ে। আমি বাইরে থেকে আসলে আমাকে জড়িয়ে ধরত। সবার সাথে মিশত। সবার আদরের ছিল। সবাই তাকে অনেক আদর করত। আজ সে নেই। তাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে। আমার মেয়ের হত্যার বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন আমার মেয়ের হত্যার যেন বিচার হয়। হত্যাকারীর যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।’
সায়মার হত্যাকারীর শাস্তি চায় এলাকাবাসী
শিশু সায়মা ছিল এলাকার সবার প্রিয়। সবার মুখে মুখে তার হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি চাচ্ছেন বনগ্রাম এলাকাবাসী। হত্যাকারীর যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। তার শাস্তি দেখে যেন অন্য কেউ এমন অপরাধ করতে না পারে; এমনটাই দাবি বনগ্রামবাসীর।
বনগ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ হোসেন বলেন, সায়মা ছিল সবার প্রিয়। তার হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়ার মতো নয়। তাকে যে হত্যা করেছে তার যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়।
জামান উদ্দিন বলেন, সায়মার হত্যাকারীর যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। সরকার যেন সায়মা হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে।
ঘটনার বর্ণনা
গত শুক্রবার রাজধানীর ওয়ারী সিলভারডেল স্কুলের নার্সারির ছাত্রী সামিয়া আফরিন সায়মাকে ছাদ ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে আটতলার লিফট থেকে ছাদে নিয়ে যায় ফ্ল্যাটের মালিক পারভেজের খালাতো ভাই হারুন অর রশিদ। সেখানে নবনির্মিত নবম তলার ফ্ল্যাটে সায়মাকে ধর্ষণ করে সে। এরপর নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে থাকে সায়মা। মৃত ভেবে সায়মার গলায় রশি দিয়ে টেনে রান্নাঘরের সিঙ্কের নিচে রেখে পালিয়ে যায় হারুন।
শিশু সায়মা হত্যার ঘটনায় রোববার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই রোমহর্ষক বর্ণনা দেন অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আব্দুল বাতেন।
ডিএমপির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত কুরুচির পরিচায়ক; মানবতাবিরোধী অপরাধ। এ ধরনের অপরাধীরা সাধারণত ধর্ষণের পর যখন ভাবে এ অপকর্মের কারণে সে বাঁচতে পারবে না তখনই হত্যার মতো ঘটনা ঘটায়। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটিয়েছে ঘাতক হারুন।’
ঘটনার পূর্বাপর বিবরণ দিতে গিয়ে আব্দুল বাতেন বলেন, ‘শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। ওই দিন মাকে বলে শিশু সায়মা আটতলায় যায়। সেখানে ফ্ল্যাট মালিক পারভেজের একটি বাচ্চা আছে তার সঙ্গে খেলা করতে। সেখানে গেলে পারভেজের স্ত্রী জানান তার মেয়ে ঘুমাচ্ছে। সেখান থেকে বাসায় ফেরার উদ্দেশে লিফটে ওঠে সায়মা। লিফটেই সায়মার সঙ্গে দেখা হয় পারভেজের খালাতো ভাই হারুনের। হারুন সায়মাকে লিফট থেকে ছাদ দেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে অত্যন্ত পাশবিকভাবে সায়মাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। সায়মা চিৎকার করলে মুখ চেপে ধর্ষণ করে। সায়মাকে নিস্তেজ দেখে গলায় রশি লাগিয়ে টেনে নিয়ে যায় রান্নাঘরে। সেখানে সিঙ্কের নিচে রাখে। এরপর পারভেজের বাসায় না ফিরে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার ডাবরডাঙ্গা এলাকায় পালিয়ে যায় হারুন।’
ধর্ষক ও হত্যাকারী হারুন গ্রেফতার
ধর্ষণের পর হত্যার শিকার শিশু সামিয়া আফরিন সায়মার হত্যাকারী হারুন অর রশিদকে রোববার তাকে কুমিল্লার তিতাস থানার ডাবরডাঙ্গা এলাকা থেকে গ্রেফতার গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইফতেখার আহমেদ জানান, গ্রেফতার হারুনের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার ডাবরডাঙ্গা এলাকায়। ঘটনার পর সে পলাতক ছিল। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল। পরে পুলিশ তার অবস্থান শনাক্ত করে তাকে কুমিল্লা থেকে ধরে আনে।
এদিকে শিশু সায়মার বাবা আব্দুস সালাম জানান, ঘাতক হারুন অর রশিদ ফ্ল্যাট মালিক পারভেজের খালাতো ভাই। সে ভবনের অষ্টম তলায় পারভেজের বাসায় থাকতো এবং ঠাঁটারীবাজারে একটা রঙের দোকানে কাজ করতো।
শিশু সায়মা হত্যার প্রতিবেদন ২৪ জুলাই
সামিয়া আফরিন সায়মাকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৪ জুলাই দিন ধার্য করেছেন আদালত। শনিবার (৬ জুলাই) মামলার এজাহার গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ দিন ধার্য করেন ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুর রহমান। এদিন সকালে শিশুর বাবা আব্দুস সালাম বাদী হয়ে ওয়ারী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এ মামলা করেন।
উল্লেখ্য, শুক্রবার (৫ জুলাই) সন্ধ্যার পর থেকে শিশু সায়মার খোঁজ পাচ্ছিল না তার পরিবার। আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নবনির্মিত ভবনটির নয়তলার ফাঁকা ফ্ল্যাটের ভেতরে সায়মাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান পরিবারের সদস্যরা। খবর পেয়ে রাত ৮টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ওই ভবনের ছয়তলায় পরিবারের সঙ্গে থাকত সায়মা। বাবা আব্দুস সালাম নবাবপুরের একজন ব্যবসায়ী। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার ছোট সায়মা। ওয়ারী সিলভারডেল স্কুলের নার্সারিতে পড়ত সে।
আব্দুস সালাম বলেন, সন্ধ্যার পর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার মাকে বলে, ‘আমি উপরে পাশের ফ্ল্যাটে যাচ্ছি, একটু খেলাধুলা করতে।’ এরপর থেকে নিখোঁজ হয় সায়মা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নবম তলায় খালি ফ্ল্যাটের ভেতরে গলায় রশি দিয়ে বাঁধা ও মুখে রক্তাক্ত অবস্থায় মেয়েকে দেখতে পাই।
জেএ/বিএ/পিআর