ইসরায়েলে রেলওয়ের এডিজির ছেলে, রাষ্ট্রীয় তথ্য পাচারের আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:১৩ পিএম, ৩০ জুন ২০১৯

বাংলাদেশি পাসপোর্টে স্পষ্টভাবে লেখা আছে, ‘এই পাসপোর্ট দিয়ে পৃথিবীর যেকোনো দেশে ভ্রমণ করা যাবে, ইসরায়েল ছাড়া’। এমন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বাংলাদেশি নাগরিক ড. সাদমান জামান পাড়ি জমান ইসরায়েলে। গ্রহণ করেন জুডাইজম (ইহুদি ধর্মের মতাদর্শ)। বিষয়টি দুই বছর আগে জানাজানি হলে বাংলাদেশি মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাদমানকে ভুলতে শুরু করেছিল বাংলাদেশিরা। তবে সম্প্রতি একটি সংবেদনশীল তথ্যে আবারও আলোচনায় আসেন ২৭ বছর বয়সী ওই যুবক। জানা গেছে, সাদমানের বাবার নাম মো. শামছুজ্জামান। তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি রোলিং স্টক) হিসেবে কর্মরত।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সাদমান প্রায়ই ইসরায়েলি টিভি চ্যানেলে আসেন। তিনি তার বাবাকে নাস্তিক ও মা-কে মুসলমান দাবি করেন। ইসরায়েলে পাড়ি জমানোর আগে তিনি লন্ডনে ডাক্তারি পড়তে যান। সেখান থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশের আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েলে পাড়ি দেন।

southeast

তবে দেশটির সরকার কোনো কারণ ছাড়া তাকে ইসরায়েলে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। দেশটিতে প্রবেশের আগে ব্রিটেনে একটি ইহুদিবাদী সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। তাদের মাধ্যমে ধর্ম পরিবর্তন করেন। এরপর ইসরায়েলে পাড়ি দেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইসরায়েলের জাতীয় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি- মোসাদ’র একাধিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী হিসেবে সে দেশে পা রাখেন সাদমান।

মোসাদ মূলত নিজ দেশের সীমানার বাইরে শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোর গোপন, স্পর্শকাতর ও অতিব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে এজেন্ট নিয়োগ দেয়। বাংলাদেশি গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সাদমানের সঙ্গে মোসাদের সদস্যরা সবসময় যুক্ত থাকেন। তারা সাদমানের নৈকট্য লাভের নামে তার কাছ থেকে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেন। আর সাদমান এসব তথ্য পাচ্ছেন বাবা, রেলের এডিজি শামছুজ্জামানের কাছ থেকে।

বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের শঙ্কা, মোসাদের পক্ষ থেকে সাদমানকে তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে নানা ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মূলত তথ্য হাতিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সচেতন বা অসচেতনভাবে ছেলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি সরকারি নানা তথ্য বিনিময় করছেন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এছাড়া সাদমান ইসরায়েলে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস, সেখানকার মিলিটারি ক্যাম্প, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন ধরনের তথ্য উপস্থাপন করেছেন, তা নিয়েও শঙ্কায় আছেন বাংলাদেশি গোয়েন্দারা। তারা জানান, সাদমান তার বাবা-মার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেন। এ ধরনের তথ্য-প্রমাণও তাদের (বাংলাদেশি গোয়েন্দা) কাছে আছে। একজন শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে একজন রাষ্ট্রদ্রোহীর (ছেলে সাদমান) সঙ্গে কথা বলা যায় কিনা- তা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন গোয়েন্দারা।

samsuzzaman

বাবা শামছুজ্জামান ২০১৮ সালের নভেম্বরে যুক্তরাজ্যে ছেলের কাছে যান। সেখানে তিনি বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন- এমনও তথ্য আছে গোয়েন্দাদের কাছে।

বাংলাদেশ পাসপোর্ট আইনে যা বলা হয়েছে

বাংলাদেশ পাসপোর্ট আইন- ২০১৭ (খসড়া) এর ১৩ (২-ক) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি পাসপোর্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো কার্যে বা অপরাধে ব্যবহার করে তাহলে ন্যূনতম দুই থেকে পাঁচ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

জৈন ধর্ম গ্রহণ প্রসঙ্গে সাদমান যা বলেন

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জৈন ধর্ম গ্রহণ করে ইসরায়েলে পা রেখে সে দেশের আই টুয়েন্টিফোর নিউজ টিভিতে সাক্ষাৎকার দেন সাদমান। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে গেলে অ্যারেস্ট (গ্রেফতার) হব। কিন্তু আমার বাবা-মা সেখানে আছেন। আমি আমার বাবা-মার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করি। আমার বাবা একজন নাস্তিক। আমার জৈন ধর্ম পালনের বিষয়ে উনি আমাকে বলেছেন, যেহেতু আমি প্রাপ্তবয়স্ক, তাই এটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত। আমার মা মুসলমান।’

আরও যেসব অভিযোগ শামছুজ্জামানের বিরুদ্ধে

রেলের এডিজি শামছুজ্জামানের বিরুদ্ধে শুধু তথ্য পাচার নয়, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আদায়, অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

samsuzzaman

সূত্র জানায়, এডিজি শামছুজ্জামানের দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু রয়েছেন। গত ৪-৫ বছর ধরে তারাই রেলের সব কোচ সরবরাহের টেন্ডার জিতছেন। ওই দুজনকে কাজ পাইয়ে দিয়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে লন্ডনে ছেলেকে একটি বাড়ি ও দুটি অভিজাত গাড়ি কিনে দিয়েছেন। লন্ডনে ছেলে সাদমানের নামে আরও সম্পদ ও ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে। যার উৎস বাবা এডিজি শামছুজ্জামান।

গোয়েন্দা তথ্যে আরও জানা যায়, শামছুজ্জামানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আফসার বিশ্বাস (বিশ্বাস কন্সট্রাকশন ও বাঁধন এন্টারপ্রাইজের মালিক)। ২০১৬ সাল থেকে তারই যোগসাজশে বিশ্বাসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ইন্দোনেশিয়ার পিটি-ইনকা’ রেলের টেন্ডার পাচ্ছে।

এছাড়া শামছুজ্জামানের আরেক বন্ধু এ টি এম জাফরুল হাসান ডন। তিনি মেগাটেক জিএনবিডি, ঢাকার প্রধান উপদেষ্টা। শামছুজ্জামানের রেফারেন্সে রেলের বগি সরবরাহের বড় একটি কাজ পায় প্রতিষ্ঠানটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, আফসার ও ডন শামছুজ্জামানের ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেন। ওই দুজন টেন্ডার দুর্নীতির টাকা শামছুজ্জামানকে না দিয়ে সরাসরি তার ছেলের লন্ডনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেন। গোয়েন্দারা সাদমানের অ্যাকাউন্টে ইন্দোনেশিয়া, দুবাই, হংকং, চীন ও সিঙ্গাপুরের কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।

samsuzzaman

ইসরায়েলে বসবাসরত ছেলের সঙ্গে লন্ডনে গিয়ে সরকারি তথ্য পাচার ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে জাগো নিউজের পক্ষে মো. শামছুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। রোববার প্রায় ১০ বার তার সরকারি মোবাইল ফোনে কল দেয়া হয় কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। সরাসরি অ্যাপয়েনমেন্ট চেয়েও পাওয়া যায়নি।

পরে রেল ভবনে তার দফতরে গেলে তিনি তার সহকারী পাঠিয়ে এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি এখন মিটিং নিয়ে ব্যস্ত। কোনো কথা থাকলে আগামী সপ্তাহে বলবেন।

বারবার রেলওয়ের টেন্ডার পাওয়ার বিষয়ে জানতে ‘বিশ্বাস কন্সট্রাকশন’ ও ‘বাঁধন এন্টারপ্রাইজ’র মালিক আফসার বিশ্বাসের ব্যক্তিগত দুটি মোবাইল ফোনে কল দেয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

এআর/আরএস/এমএআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন