যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল খাঁন সাহেবের, অথচ


প্রকাশিত: ১০:৪০ এএম, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধের সময় এখনকার মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল না। সেই দুঃসহ সময়ে যুদ্ধের চিত্রগুলো ক্যামেরার লেন্সে আবদ্ধ করা এখনকার মতো এত সহজও ছিল না। কিন্তু দুর্গম পথই দুর্বার পথিকের জন্ম দেয়। শত প্রতিকূলতার মাঝে ওই সময় সংবাদপত্রের মাধ্যমে অবদান রেখেছিলেন তিনি। এমনই একজন দুঃসাহসিক ফটোগ্রাফার ঠাকুরগাঁওয়ের আজাহার উদ্দিন খাঁন। অথচ এখন সেই দুঃসাহসিক ফটোগ্রাফারের করুন অবস্থা। বয়সের ভারে বিছানা আকড়ে ধরেছে তাকে। বলতে গেলে এক রকমের শয্যাশায়ী তিনি। বয়সের কারণে ফটোগ্রাফী ছেড়ে দেয়ায় দীর্ঘদিন বেকার হয়ে আছেন খাঁন সাহেব। অনেক কষ্টে চলছে তার সংবার জীবন। অসুস্থ শরীর নিয়ে এই ফটোগ্রাফার তার ৬০ বছরের কর্মজীবন নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় তুলে ধরেছেন ওই সময়ের নানা স্মৃতিময় কাহিনী।

১৯৩২ সালের সিরাজগঞ্জ জেলার সোয়াধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আজহারুল ইসলাম খাঁন সাহেব। তার বাবার নাম হোসেন উদ্দিন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন উরন্ত মনের। তাই বেশিদুর লেখাপড়া করতে পারেন নি তিনি।

Thakurgaon-Khan-Saheb-2

১৯৫২ সালে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন বিভিন্নস্থানে। এরই সুবাদে ১৯৫৬ সালে ঢাকায় আব্দুল গনি হাজারির হাত ধরে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রথম ফটোগ্রাফার হিসেবে যোগদেন তিনি । বেশিদিন থাকা হয়নি সেখানে তার। এরপরেই ১৯৫৮ সালে অবজার্ভার পত্রিকায় প্রশেস ফটোগ্রাফারের কাজে যোগদেন তিনি। সেখানেও বেশিদিন ছিলেন না খাঁন সাহেব। এরপর ১৯৬০ সালে ঠাকুরগাঁও শহরে চলে আসেন তিনি। এরপর তিনি এখানেই ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে মির্জা রুহুল আমিনের (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাবা) উৎসাহে ১৯৬৫ সালে শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছবি ঘর নামে একটি স্টুডিও চালু করেন তিনি। ওই সময় ঠাকুরগাঁওয়ের একমাত্র ফটোগ্রাফার হলেন আজহারুল ইসলাম খাঁন সাহেব। এরপর থেকে যেখানেই ছবির প্রয়োজন সেখানে খাঁন সাহেব হাজির। ওই সময় ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিকদের ছবির চাহিদা পূরণ করতেন তিনি।

এরপর ১৯৭১ সাল। শুরু হলো  মহান মুক্তিযুদ্ধ। এসময়ও তিনি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরে আজহার উদ্দিন খাঁন জাগো নিউজকে জানান, ওই সময় তিনি পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশি জোয়ানদের একত্রিত করে ভারতে ট্রেনিং এর জন্য পাঠাতেন। ওই সময় বিবিসির সংবাদ ছিল বহুল প্রচারিত। একদিন বিবিসিতে সংবাদ প্রচার হয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। সংবাদটি ছিল এরকম, ভারতের কলকাতায় ৩০০ মাইল  বর্ডার বেল্টে ঘুরে বিবিসির সাংবাদিকরা কোনো মুক্ত এলাকা খুঁজে পায়নি। এ সংবাদ শোনার পরে আমি চিন্তা করলাম কিভাবে এ নিউজটার প্রতিবাদ দেয়া যায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে সেময় তেতুলিয়ায় ট্রেনিং নিচ্ছিল তা আমাকে তুলে ধরতে হবে। নিউজ প্রচারের ঠিক দুইদিন কী, তিনদিন পরে ভারতে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে একটি দল বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণে আসে। পর্যবেক্ষণ দলে ছিলেন সমিতির সভাপতি ড. তিরগুনা সেন ও ভারতের লোকসভার সদস্য সন্তোষ কুমার ভট্টাচার্যসহ কয়েকজন। তখন তারা পর্যবেক্ষণের জন্য পঞ্চগড় তেতুলিয়ায় আসেন। সেখানে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেখেন। আমি সেই অবস্থায় তাদের কয়েকটি ছবি তুলি। সেই ছবিগুলো পরে ড. তিরগুনা সেনের মাধ্যমে টাইম অফ ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্থান টাইম পত্রিকায় প্রকাশ করাই। সেই ছবিগুলো দেখে পরে গোটা বিশ্ব জানতে পারে যে বাংলাদেশে মুক্ত এলাকা আছে এবং আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।

Thakurgaon-Khan-Saheb-3

এসময় তিনি আরো জানান, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে আমি ভারতের রায়গঞ্জ সেক্টর থেকে বুড়িমারী পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ আদান প্রদান করা শুরু করি। আমার ছবি পরবর্তীতে অনেক বার পত্রিকায় ছাপা হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করে। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা মুক্ত হতে থাকে। অবশেষে পঞ্চগড় ২৯ জানুয়ারি মুক্ত ঘোষণা করলে বাড়ি ফেরার পথে আমার মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ষিত সকল ছবির ব্যাগটি হারিয়ে যায়।

এরপরে আমি ঠাকুরগাঁওয়ে এসে আমার পুরাতন ছবি ঘর স্টুডিও চালু করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করি। তখন থেকেই ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় সাংবাদিকদের ছবি সংগ্রহে সাহায্য করতাম।

খাঁন সাহেব জানান, আগের মতো শরীরে এখন আর শক্তি পাইনা। আগে আমি ছবি তুলতাম আমার মনের মতো করে। আর এখন ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে হয় ক্যামেরার মতো করে।

তিনি বলেন, আমি এখন তেমন চলাচল করতে পারি না। আমার এক ছেলে তিন মেয়ে। ছেলে ঢাকায় পড়ালেখা করে। তাকে নিয়ে চিন্তায় থাকি। তার পড়ালেখার খরচ চালানো আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।  

কষ্ট ভরা মনে খাঁন সাহেব জাগো নিউজের এই প্রতিবেদককে বলেন, এক সময় আমাকে ফোন করতেন ঠাকুরগাঁওয়ের সব উচ্চমহলের লোকজন। যেখানেই কোনো অনুষ্ঠান বা সমাবেশ হতো সেখানেই ফটোগ্রাফার হিসেবে আমাকে রাখা হতো। প্রশাসনের বড় বড় কর্তারা ছুটে আসতেন আমার বাড়িতে। সেই সময় মির্জা রুহুল আমিন। বর্তমানে তার ছেলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সবাই আমার তোলা ছবি নিত। সবাই তখন আমাকে অনেক পছন্দ করতো। কিন্তু এখন আর কেউ আমার খবর নেই না।

Thakurgaon-Khan-Saheb-4

তিনি বলেন, যুদ্ধ করিনি। কিন্তু যুদ্ধের সময় কিছু ছবি তুলে তা প্রকাশ করেছি বিভিন্ন মিডিয়ায়। বাংলাদেশের পরিচিতি ঘটিয়েছি। জানিনা এটি দেশের জন্য কোনো অবদান কী না। অথচ কোনো মূল্যায়ন পাইনি আজো।

ঠাকুরগাঁওয়ের প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল লতিফ জানান, আগে আমরা খাঁন সাহেবের কাছে ছবি নিয়ে পত্রিকায় পাঠাতাম। তখন ঠাকুরগাঁও শহরে একমাত্র ফটো সাংবাদিক খাঁন সাহেবই ছিলেন। তার তোলা ছবি ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক সময় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এখন দেশে তথ্য প্রযুক্তি উন্নতির কারণে খাঁন সাহেবকে তার পুরাতন পেশা ছাড়তে হয়েছে।

ঠাকুরগাঁও শহরের হোটেল ব্যবসায়ী আব্দুল হামিদ জানান, খাঁন সাহেবের অবদান সম্পর্কে ঠাকুরগাঁওসহ সারাদেশের নতুন প্রজন্মকে জানা উচিত। এখন অনেকেই খুব সহজেই প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আধুনিক ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তুলছেন। অথচ খাঁন সাহেব অনেক কষ্ট করে ঠাকুরগাঁওয়ের চিত্র তুলে ধরতেন তার ক্যামেরায়। প্রবীণদের এসব অবদান মনে রাখা উচিত নতুন প্রন্মকে।

ঠাকুরগাঁওয়ের প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর মনতোষ কুমার দে জানান, জেলায় খাঁন সাহেবই ছিলেন একমাত্র ফটোগ্রাফার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছবি তোলার জন্য তাকে আমন্ত্রণ করা হতো। তার ছবি তোলার হাত ছিল অতুলনীয়। কালের আবর্তে খাঁন সাহেব এই পেশায় এখন নেই বলে শুনেছি। কিন্তু খাঁন সাহেবের তোলা ছবি অনেক জাতীয় পত্রিকায় ছেপে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।

এমএএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।