কীভাবে পাবো প্রধানমন্ত্রীর দেখা


প্রকাশিত: ০৯:৩২ এএম, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবসটি প্রতি বছর আসে। কিন্তু গণশিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত ও প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ঠাকুরগাঁওয়ের মোকছেদ আলীর পরিবারের খোঁজ রাখেন না কেউ। স্বাক্ষরতা আন্দোলনের মহানায়কের ছেলের পরিচয়ে সামান্য একটি চাকরির আশায় তিন বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের আশপাশে ঘুরে নিজ গ্রামে ফিরে এসেছেন মোকছেদ আলীর ছেলে আল-আমিন।

১৯৯৯ সালে আলিম পাস করার পর চাকরি না পেয়ে তিনি এখন অন্যের জমি বর্গা নিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন।
আল-আমিন হলেন ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ী কৃষ্টপুর এলাকাকে বাংলাদেশের প্রথম ‘নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম’ তৈরির মহানায়ক মোকছেদ আলীর একমাত্র ছেলে।

এমনকি অনেক চেষ্টা করেও যেমন নিজের চাকরি যোগাতে ব্যর্থ হয়েছেন আল-আমিন তেমনি একইভাবে ব্যর্থ হয়েছেন বাবার মৃত্যুর পর মায়ের জন্য বয়স্ক ভাতার কার্ড যোগাড় করতেও।

১৯৫৫ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ী এলাকায় অভাবী এক পরিবারে জন্ম মোকছেদ আলীর। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় অনেক আগ্রহী হওয়ায় বাবার অভাবের সংসারের মধ্যেও এইচএসসি পাস করেন তিনি।

১৯৭২ সালে তৎকালীন সরকার দেশব্যপী স্বাক্ষরতা আন্দোলনের ডাক দিলে সবার আগে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কচুবাড়ী কৃষ্টপুর গ্রামের একমাত্র শিক্ষিত যুবক মোকছেদ আলী।

বাড়ির পাশেই পল্লী উন্নয়ন নামে একটি ক্লাবে স্থানীয় মানুষজনকে নিয়ে পাঠশালা গড়ে তোলেন তিনি। দিন-রাত একাকার করে বিনা পারিশ্রমিকে স্থানীয় মানুষজনকে স্বাক্ষর করে তোলেন তিনি।

অন্যদিকে, তার এই সফল উদ্যোগের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। এরপর সরকারিভাবে স্বাক্ষরতার জরিপ শুরু হয় দেশ জুড়ে। সরকারের এ জরিপে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশের প্রথম নিরক্ষর মুক্ত এলাকার ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ী কৃষ্টপুর গ্রাম এবং এই মহানায়কের নাম।

এরপর সরকারিভাবে বাংলাদেশের সর্ব প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম ঘোষণা করা হয় এ গ্রামকে। তখন থেকে এই এলাকার নামকরণ করা হয় `আদর্শ গ্রাম`।

বাংলাদেশের হিমালয় ঘেঁষা জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের এই মহানায়ক মোকছেদ আলীর সফলতার চিত্র দেখতে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছুটে আসেন তার বাড়িতে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আসেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী, চিত্রপরিচালক চাষী নজরুল ইসলামসহ দেশবরেণ্য আরো অনেকেই।

Thakurgaon-Allamin

রাষ্ট্রপতি মোকছেদ আলীর বাড়িতে এসে এলাকা জুড়ে তার ব্যাপক সফলতা দেখে খুশি হয়ে তাকে ঢাকায় চাকরির প্রস্তাব দেন। এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে চাকরি করার প্রস্তাবটি তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রপতিকে ফিরিয়ে দিয়ে পাশের এলাকার মানুষকে দ্রুত নিরক্ষর মুক্ত করার সহযোগিতা চান তিনি।

রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঠাকুরগাঁও থেকে ফিরে ‘এলাকা-প্রেমিক’ মোকছেদ আলীকে ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রপতি পদকে ভূষিত করেন।

অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে মোকছেদ আলীর এ সফলতার কথা শুনে একই সালের ২৭ আগস্ট ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ী এলাকায় আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর আগমনের কথা শুনেই অবহেলিত এ জেলার মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সেই সঙ্গে এলাকায় শুরু হয় সাজগোজের প্র্রস্তুতি।

এর কিছুদিন পরেই ১৫ আগস্ট দেশবরেণ্য নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর সংবাদে দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। একইভাবে শোকে কাতর হয়ে পড়েন কচুবাড়ীর এলাকার মানুষজনও।

শোক কেটে আবারও এলাকায় নিরক্ষরতার সঙ্গে যুদ্ধে নামেন মোকছেদ আলী। বাবার কাছ থেকে পাওয়া সামান্য কৃষি জমি চাষ করে সংসার চালিয়ে এলাকার মানুষের পাশে শিক্ষার প্রদীপ বহন করেন তিনি।

এভাবে কিছুদিন চলার পর ২০০০ সালের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েনি তিনি। পরিবারে তখন স্ত্রী ও তিন সন্তান। অসুস্থতার মধ্যেই বড় মেয়ে আমিনা নুরীকে বিয়ে দেন। অসুস্থ এই মানুষটিকে নিয়ে হিমশিম খেতে শুরু করেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।

বাবার চিকিৎসার টাকা যোগাতে সব কৃষি জমি বিক্রি করে দেন ছেলে আল-আমিন। এক পর্যায়ে সব টাকা ফুরিয়ে গেলে ২০০৭ সালে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় রাষ্ট্রপতি পদক পাওয়া এ মহা নায়কের।

বাবার মৃত্যুর পর ছোট বোন আম্বিয়া খাতুনসহ মাকে নিয়ে অসহায় জীবন-যাপন শুরু হয় আল-আমিনের। ১৯৯৯ সালে আলিম পাস করা এই যুবক অন্যের বাড়িতে কাজ করে বোনের পড়ালেখা ও সংসারের হাল ধরেন।

মোকছেদ আলীর মৃত্যুর পর দেশের জন্য এ মানুষটির অবদানের কথা ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় সংবাদকর্মীরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তুলে ধরেন। কিন্তু সরকারের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের কারো নজরে আসেনি মহানায়কের পরিবারটির অসহায়ত্ব।

সরেজমিনে মোকছেদ আলীর বাড়িতে গিয়ে তার পরিবার এসব অভিযোগ করেন। মোকছেদ আলীর ছেলে আল-আমিন বলেন, বাবার মৃত্যুর পর স্থানীয় সাংবাদিকরা জেলা প্রশাসকের কাছে এমএলএসএস পদে আমাকে একটি চাকরি দেয়ার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু আজও আমার চাকরি হয়নি।

আল-আমিন বলেন, কিন্তু যতবারই তৎকালীন জেলা প্রশাসক শহীদুজ্জামানেরর কাছে গেছি, তিনি আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু এভাবে ছয়মাস আমাকে ঘুরিয়েছেন। কিন্তু, চাকরি হয়নি।

তিনি বলেন, ২০১১ সালে সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের সুপারিশ নিয়ে একটি আবেদনপত্রসহ তিন বছর ধরে ঘুরেছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু, আমাকে দেখা করতে দেয়নি। কীভাবে পাবো প্রধানমন্ত্রীর দেখা, কেউ কি জানাবেন আমাকে!

তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীকে আব্বার পরিচয় দিয়ে কথা বললে তিনি একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন আমাকে।

আল-আমিন আফসোস করে বলেন, আমার মায়ের জন্য একটি বিধবা ভাতা কার্ড পেতে এলাকার চেয়ারম্যানের কাছে একাধিকবার গেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি কার্ডও পেলাম না। তিনি বলেন, আমার বাবার বিশাল এই পরিচিতি শুধু মুখে মুখেই। দূর থেকে কোনোভাবে চেনার উপায় নেই এটিই মোকছেদ আলীর সেই গ্রাম।

সরকারের উদ্দ্যেশে তিনি বলেন, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও মহাসড়ক থেকে এক কিলোমিটার ভেতরে আমাদের গ্রাম। এই রাস্তাটি আমার বাবার নামে নামকরণ করা হোক। তাহলে আগামী প্রজন্ম সহজেই জানতে পারবে, কে এই মোকছেদ আলী!

এ ব্যাপারে সালন্দর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলে এলাহী মুকুট চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে একটি কার্ডের ব্যবস্থা করে দেবো।

এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস জাগো নিউজকে জানান, মোকছেদ আলীর স্ত্রী জাহেদা খাতুনকে দ্রুত বয়ষ্ক ভাতা কার্ডের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। সেই সঙ্গে তিনি মোকছেদ আলীর পরিবারকে অন্যান্য সহযোগিতা করারও আশ্বাস দেন।

এমজেড/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।