উফ্! কী নিষ্ঠুর নির্যাতন (অডিও)
‘তুই হালুয়ার সাথে হলুদ মরিচের গুড়া মিক্সড করছস। আমি বার বার বলছি, আমি কিছু মিক্সড করি নাই। এ সময় ঊনি বলেন, তুই যদি না বলস তাহলে তোকে আমি পেটাবো। তুই হ্যাঁ বলবি, হ্যাঁ, আমি মিক্সড করছি। আমি তোর মুখে আর না শুনতে চাইনা, তোর মুখে হ্যাঁ শুনতে চাই। তুই যদি না বলস তাহলে তোরে আমি পিটাইতে পিটাইতে শেষ করে ফেলবো।
সেই ভয়ে আমি হ্যাঁ মিক্সড করছি বলছি। তারপর ঊনি আমার পেটে ঘুষি মারছে। শুয়াইয়া লাইথ্যাইয়া মারধোর করছে। স্বামীকে ফোন কইরা প্রাকটিস শেষে আসার সময় লাঠি কিনে এনে আবার পিটাইতে কইছে।’
সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিসাধীন ১৩ বছরের কিশোরী গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপি হুইল চেয়ারে বসে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে জাতীয় দলের পেস বলার শাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রী নিত্য দম্পত্তির হাতে নির্যাতনের ঠিক এভাবেই বর্ণনা দেয়।
হ্যাপি জানায়, আগের দিন রাতেও সারারাত কাজ করছি। বাথরুম ধুইছি, ঘর মুছছি, থালা বাসন ধুইছি। পাক (রান্না) ঘর মাইজ্যা পরিষ্কার করছি। কাম করতে করতে সকাল হইয়া গেছে।
সে আরো বলে, সকালে প্রাকটিসে যাওয়ার আগে নাস্তা গরম করে দেয়ার সময় একটি ঝিমিয়ে পড়ায় তার স্বামী (ক্রিকেটার শাহাদাত) আমার পেটে লাথি মারে। ওই দিন সকালে ছুটা বুয়া বাসায় কাজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় গেট বন্ধ করার ভান করে আমি পালিয়ে আসি।’
সে জানায়, এক বছর আগে তার নানীর মাধ্যমে শাহাদাত হোসেনের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ নেয়। প্রথম কিছুদিন কাজে ভুলক্রুটি হলে দু’জনেই বকাঝকা করতো। কিন্তু মাসখানেক পর থেকেই যৎসামান্য ভুলের অজুহাতে গায়ে হাত তুলতো। কখনো খালি হাতে চড়-থাপ্পড় ও কিলঘুষি মারতো।
আবার কখনো লাঠি, কখনও বেত কিংবা আলমারিতে শাড়ি রাখার হ্যাঙ্গার দিয়ে পেটাতো। গত এক বছরে কমপক্ষে ৫/৬ টা ডাল ঘুটুনি ভাঙ্গছে। মারধোর করলেও কখনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতোনা। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে ব্যথার ওষুধ কিনে এনে খেতে দিতো।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে হ্যাপি জানায়, তিন রুমের বাসায় তাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝাড়ু দেয়া, ঘর মোছা, বাথরুম পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া, থালাবাসন মাজা, মশলা পেষার পাশাপাশি রান্না-বান্নায় সাহায্য করতে হতো। কাজের চাপ এত বেশি থাকতো অনেক সময় ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ২/৩টা বেজে যেতো। ঘুমাতে না ঘুমাতেই আবার সকাল বেলা শাহাদাত হোসেন প্রাকটিসে যাওয়ার আগে নাস্তা তৈরির জন্য উঠে পড়তে হতো।
ওসিসির কো-অর্ডিনেটর ডা. বিলকিস বেগম জাগো নিউজকে বলেন, হ্যাপির সারা শরীরে নির্যাতনের দগদগে ক্ষতচিহ্ন। মুখমণ্ডলে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষিতে দু’চোখের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। বাম পায়ে গোড়ালির হাড় ভাঙ্গা। দু’হাত ও দু’পায়ে নির্যাতনের পুরোনো ক্ষতচিহ্ন। পিঠে বেতের আঘাতের লম্বা দাগ। উফ্ কি নির্মম, নিষ্ঠুর পাশবিক নির্যাতন। মানুষ মানুষের ওপর এমন নির্যাতন চালাতে পারে?
তিনি জানান, রোববার দিবাগত রাত সাড়ে চারটায় মিরপুর থানা পুলিশ তাকে ওসিসিতে ভর্তি করে। সকালে তাকে নিউরোসার্জারি ও অর্থপেডিকস্ বিভাগের ডাক্তাররা দেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন। বর্তমানে চিকিৎসার পাশাপাশি ওসিসিতে তাকে কাউন্সিলিং করা হচ্ছে বলে জানান ডা.বিলকিস বেগম।
কিশোরী হ্যাপি কখনো বাবা মায়ের স্নেহ পায়নি। বাবা আবেদ আলী ছিলেন পেশায় ড্রাইভার। মা পেয়ারা বেগম মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন।
হ্যাপি খুব ছোট থাকতেই বাবা-মা দু’জনেই তালাক নিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। নানী রাবেয়া বেগমের কোলে-পিঠেই মানুষ হয়েছে সে। ছোটবেলা থেকেই মানুষের বাড়িতে কাজ করে বড় হয়েছে হ্যাপি।
রোববার রাতে রাজধানীর কালশী থেকে পল্লবী থানা পুলিশ শাহাদাতের গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপিকে (১১) উদ্ধার করে। হ্যাপি তার ওপর অমানবিক নির্যাতনের জন্য শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী নিত্য শাহাদাতের কথা জানায়।
পরে হ্যাপিকে মিরপুর মডেল থানায় পাঠালে সেখানে খন্দকার মোজাম্মেল হক নামে স্থানীয় একজন সাংবাদিক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
এ ঘটনায় পুলিশের মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ভুইয়া মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, মেয়েটিকে উদ্ধারের পর থেকেই শাহাদাতের বাসভবনসহ সম্ভাব্য কয়েকটি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে তার বাড়িতে গিয়ে তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তারা পলাতক রয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব তাদের গ্রেফতার করা হবে। অভিযান চলছে।
# ক্রিকেটার শাহাদাতের বাসায় নির্যাতিত হ্যাপির জবানবন্দি (অডিও)
এমইউ/এসএইচএস/আরআইপি