কক্সবাজার থেকে থাইল্যান্ড: দাস ব্যবসার নতুন রুট


প্রকাশিত: ০৩:৩৭ এএম, ১৯ অক্টোবর ২০১৪

থাইল্যান্ডের টাকুয়া পা শহরে স্থানীয় সরকারের এক ভবনে এখন আশ্রয় নিয়েছে ৮১ জন মানুষ। নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত অনেকের শরীর। তাদের চোখের দৃষ্টিতে শূন্যতা।

যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তারা গেছে, সেকথা বলতে গিয়ে গাল বেয়ে নামে চোখের জল। অনেকেরই ভাবনা জুড়ে বাংলাদেশে ফেলে আসা পরিবার। এদের সবার কাহিনী প্রায় একই রকম।

আবদুর রহিমের বয়স ১৮। বন্দী অবস্থায় আরেকটু খাবার চাওয়ায় তার ওপর চড়াও হয়েছিল অপহরণকারীরা। আঘাত সারেনি এখনো, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় তাকে।

আবদুর রহিমের বাড়ি বগুড়ায়। কাজ খুঁজতে গিয়েছিলেন ঢাকায়। সেখানে এক লোক তাকে ভালো বেতনে একটা চাকুরির প্রস্তাব দেয়।

ওইলোকের সঙ্গে আবদুর রহিম কক্সবাজার এসে পৌঁছান। একটা পাহাড়ের ওপরে একটা ছোট বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে তাকে বেঁধে রাখা হয়। মাদক দিয়ে অজ্ঞান করা হয়। জ্ঞান ফেরার পর আবদুর রহিম নিজেকে আবিষ্কার করেন এক নৌকায়। সাগরে এই নৌকায় সাত-আটদিন কেটেছে আবদুর রহিমের। তাকে বেদম পেটানো হয়।

এরপর তাদের নেয়া হয় থাইল্যান্ডের উপকূলে। সেখানে উপকূলের ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর বন্দী শিবিরে আটকে রাখা হয়।
 
২৭ বছর বয়সী আবসার মিয়ার বাড়ি টেকনাফে। স্ত্রী আর তিন সন্তান ফেলে এসেছেন বাড়িতে।“বাড়ির জন্য আমার মন কাঁদে। সারাক্ষণ ভাবি কখন বাড়ি ফিরতে পারবো, মাকে দেখতে পাবো, আমার ছেলে মেয়েদের দেখতে পাবো। ওদের জন্য কাঁদি।”

আবসারের কাহিনিও একই। তাকেও চাকুরি প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। টেকনাফে এক পাহাড়ের ধারে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া হয়। এরপর মারধোর করে নৌকায় তোলা হয়।

আইয়ুব ছিলেন চট্টগ্রামের দিনমজুর। কাজ খুঁজতে থাকায় এক লোক তাকে কক্সবাজার যাওয়ার পরামর্শ দেয়। একই ভাবে তাকেও সেখানে অপহরণ করে নৌকায় তোলা হয়।

নৌকায় আইয়ুব বার বার জানতে চেয়েছেন, তাকে কোথায় নেয়া হচ্ছে। তখন সেখানে অপহরণকারীরা তাকে হুমকি দেয়, মুখবন্ধ না রাখলে তাকে হত্যা করা হবে।

জঙ্গলের বন্দী শিবির
এই লোকগুলো যে শেষ পর্যন্ত থাইল্যান্ডের জঙ্গলের বন্দীশিবির থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তার নেপথ্য নায়ক স্থানীয় জেলা প্রশাসনের প্রধান মানিট পিয়ানথিয়ং। থাইল্যান্ডের টাকুয়া পা উপকূল জুড়ে মানবপাচার চক্রের তৎপরতা সম্পর্কে ভালোই জানেন তিনি।

মিস্টার পিয়নথিয়ং জানান, এই চক্রকে নির্মূল করার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। এজন্যে স্থানীয়দের সাহায্য চাইছেন তারা।

বাংলাদেশিদের এই বড় গ্রুপটির অবস্থান সম্পর্কে স্থানীয়রাই তাকে সতর্ক করেছিল।প্রথম গ্রুপে তারা উদ্ধার করেন ৩৭ জন। গত ১১ অক্টোবর উদ্ধার করেন ৫৩ জনকে। আর এবার সর্বশেষ অভিযানে উদ্ধার করেছেন ৮১ জনকে।

যারা এদের আটকে রেখেছিল তাদের দুজনও ধরা পড়েছে। এদের একজনকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশিরা সবচেয়ে নিষ্ঠুর বলে বর্ণনা করেছেন। তার নাম কেকে।

একালের ক্রীতদাস
থাইল্যান্ডের আন্দামান উপকূলে গত কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে মানুষের নির্যাতন-লাঞ্ছনার ভয়ংকর সব দৃশ্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূলত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরাই এর শিকার হয়েছেন।
 
২০০৯ সালে থাইল্যান্ডের নৌবাহিনী রোহিঙ্গা শরণার্থী বোঝাই নৌকা টেনে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসছিল সাগরের মাঝখানে। এসব নৌকা স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে চলে গেছে বিভিন্ন দিকে। শত শত মানুষ সাগরে ডুবে মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়।

আর অতি সম্প্রতি থাই পুলিশ এবং সামরিক সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে যে তারা থাইল্যান্ডের উপকূলে এসে পৌঁছানো রোহিঙ্গাদের বিক্রি করে দিয়েছে মানব পাচারকারীদের কাছে।

থাইল্যান্ডের বিভিন্ন সরকার এই মানব পাচারকারীদের দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু আন্দামান উপকূলের কাছে থাই জঙ্গলের বন্দী শিবির থেকে ১৭১ জনকে উদ্ধারের ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল এই সমস্যা এখনো কতটা প্রকট।

সুযোগ পেয়ে রোহিঙ্গাদের শোষণ-নির্যাতনের মাধ্যমে যার শুরু, তা এখন এক সুসংগঠিত দাস ব্যবসায় রূপ নিয়েছে। সূত্র : বিবিসি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।