পীরের মাজারে প্রেমের জিকির
‘পীরের মাজারে বসে কোনো রাতে বাউলের দল/ যেমন হঠাৎ ধরে হু হু শব্দে প্রেমের জিকির/ আমার কবিতা সেই মাতালদের রাতের গজল।’ -কবি আল মাহমুদের কবিতার ভাষা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠেছে সিলেটের শাহজালাল (র.) মাজারে। মাজার প্রাঙ্গনে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বসে আছেন অসংখ্য নারী-পুরুষ। শত শত বাউল ফকির। এদের বেশিরভাগই দেশের দূর দূরান্ত থেকে মিলিত হয়েছেন। একমনে জিকির করে চলছেন তারা। তাদের বেশিরভাগই একে অপরের অপরিচিত হলেও জিকির আর গজলের সুরে যেন এক হয়ে গেছেন।
এদিকে পা রাখার জায়গাটুকু নেই মাজার প্রঙ্গণে। তারপরও তিন ফটক দিয়ে বানের জলের মতো মানুষ ঢুকছেন। হাতে বিশাল লাল গিলাপ। সকলের কণ্ঠে জিকির। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এরমধ্যেই কেউ কেউ মাজারের পুকুরের গজার মাছকে খাবার ছুড়ে দিচ্ছেন। কেউবা খেলা করছেন কবুতরের সঙ্গে। ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রার্থনায় আছেন ভক্তরা।
গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হয়েছে সিলেট হযরত শাহজালাল (র.) মাজারের বার্ষিক ওরস মোবারক। প্রতি বছর ১৯ ও ২০ জিলকদ দুই দিনব্যাপী এ ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এবার ৬৯৬তম বারের মতো আয়োজিত হচ্ছে এ ওরস। শুক্রবার সকাল থেকেই দরগাহ প্রাঙ্গণের রাস্তাগুলো মুখরিত ছিল মিছিলে। দেশ-বিদেশ থেকে দলবেঁধে আসা ভক্তদের হাতে ছিল নানা রঙয়ের গিলাফ; আর মুখে ছিল- ‘লালে লাল–বাবা শাহজালাল, শাহজালাল বাবা কি জয়’ স্লোগান।
শনিবার ভোর রাতে আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে ওরসের আনুষ্ঠানিকতা। ভক্তরা জানান, হযরত শাহজালাল (র.) আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ ও বিশ্ব শান্তির কমনা করছেন তারা।
জানা যায়, ১৩০৩ সালে ৩৬০ জন আউলিয়াসহ ইয়েমেন থেকে সিলেট আসেন হযরত শাহজালাল (র.)। যে তারিখে তিনি সিলেট বিজয় করেন ছয় বছর পর ঠিক সেই একই তারিখে মৃত্যুবরণ করেন এ ধর্ম প্রচারক। সেই থেকে তার ওফাত (মৃত্যু) দিবস ও সিলেট বিজয় দিবসটিতে ভক্তরা আয়োজন করেন ওরস মোবারকের।
ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে এই ওরসে দুই দিনব্যাপী জিকির ও গজলে মেতে ওঠেন বাউল ফকির ও ভক্ত আশেকানরা। জীবিত অবস্থায় বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমও নিয়মিত শাহজালাল মাজারের ওরসে এসে জিকিরে শরীক হতেন।
সুফি ও বৈষ্ণব ধারার দুই প্রবাদ পুরুষ শাহজালাল ও শ্রী চৈতন্য। এদের মধ্যে প্রথম জন সুফিবাদের বাণী নিয়ে ইয়েমেন থেকে সিলেট আসেন। আর ২য় জন বৈষ্ণববাদের বাণী নিয়ে সিলেট ছেড়ে চলে যান নদীয়ায়। ধর্মের প্রেমময় দুই ধারা সে সময় সহজেই আকৃষ্ট করে সাধারণ মানুষদের। আজও শাহজালাল মাজারে ভক্তদের উপচেপড়া ভীড় তা জানান দিয়ে যাচ্ছে।
ওরস উপলক্ষ্যে কেবল মাজার নয়, পুরো নগরীই সেজেছে সাজ সাজ রবে। ভক্ত-আশেকানদের স্বাগত জানিয়ে নগরীর বিভিন্ন মোড়ে তোরণ ও ফেস্টুন তৈরি করা হয়েছে। আয়োজক কমিটির সেক্রেটারি সামুন মাহমুদ খাঁন জানান, নির্বিঘ্নে ওরসের আনুষ্ঠানিকতা পালনে পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবকসহ সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গভীর রাত পর্যন্ত জিকির ও এবাদত-বন্দেগিতে সময় কাটাবেন ভক্তরা। শনিবার রাত সোয়া ৩টায় আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে দু’দিনব্যাপী ওরস শেষ হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গিলাফ প্রদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে গিলাফ প্রদান করেন জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে গিলাফ প্রদান করেন মহানগর বিএনপি নেতৃবৃন্দ।
ছামির মাহমুদ/আরএস