পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারবেন কি-না, জানেন না তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৩১ এএম, ১১ মে ২০১৯

ঈদের ছুটিতে রাজধানী থাকে অনেকটাই ফাঁকা। বেতন-বোনাস পেয়ে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য নতুন পোশাক কিনে ঈদ উদযাপনে গ্রামে ছুটে চলেন নগরবাসী। তবে ঈদের সময় স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়াও রাজধানীতে থেকে যায় একটা অংশ। ছেলে-মেয়ে, পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উদযাপনের সৌভাগ্য তাদের হয় না। তাদেরই একটা অংশের মধ্যে রয়েছেন ঢাকার রিকশাচালক।

ঈদের সময় টুকটাক খরচ ও পরিবারের সদস্যদের নতুন পোশাক দিতে রাজধানীতে রিকশা চালাতে আসেন অনেকেই। যারা কিছুদিন বিরতি দিয়ে নিয়মিত রিকশা চালান তারাও এই কাঠ-ফাটা গরমের মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছেন রাজধানীর রাস্তায়।

শুক্রবার (১০ মে) রাজধানীতে এমন কয়েকজন রিকশা চালকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। জানার চেষ্টা করা হয়, আগামী ঈদ নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা। বর্তমান অবস্থাই-বা তাদের কেমন।

যাদের সঙ্গে কথা হয় তাদের একজন সিরাজগঞ্জ সদরের বনবাড়িয়া গ্রামের মো. আয়নাল হোসেন প্রামাণিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় দুপুর আড়াইটার দিকে ৬৩ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ রিকশা থামিয়ে বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিলেন। আয়নাল হোসেন প্রামাণিকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তার গলার স্বর শোনা যাচ্ছিল না। অসুস্থ কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না’।

কথা বলে জানা যায়, আয়নাল হোসেনের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। তার মধ্যে দুই ছেলে কর্মক্ষম, তারাও রিকশা চালান এবং আলাদা খান। বাকি যারা কর্মকক্ষ নয়, তারা আয়নাল হোসেনের সঙ্গে থাকেন। এছাড়া বিবাহিতা দুই মেয়ের সন্তানরাও আয়নাল হোসেনের সংসারেই থাকে। পুরো পরিবারের
একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি।

আয়নাল হোসেন বলেন, ‘দুনিয়াটা খুব কঠিন, চাচা। খরব বাদে সপ্তাহ শেষে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আয় থাকে, এগুলো বাড়িতে পাঠাই। তা দিয়েই কোনো রকমে চলে যাচ্ছে। যতদিন শরীর চলব, ততদিন এইভাবেই চলব। শরীর না চললে সংসার কীভাবে চলব, জানি না।’

পরিবারের সঙ্গে ঈদে করতে গ্রামে যাবেন কি না -তা জানেন না আয়নাল হোসেন প্রামাণিক। তিনি বলেন, ‘ঈদে বাড়ি যামু কি যামু না, জানি না। টাকা রোজগার না হইলে ক্যামনে যামু।’

প্রতিদিন যা উপার্জন করেন সপ্তাহ শেষে তা গ্রামে পাঠিয়ে দেন। ফলে জমানোর কোনো সুযোগ থাকে না তার। বাড়ি-ভিটা ছাড়া আর কোনো জমিজমাও নেই। আয়নাল হোসেন বলেন, ‘দেশে গেলে ঋণ করতে হবে, নইলে কেনাকাটা বন্ধ। যে টাকাই ঋণ করমু -সেটা পরে আবার রিকশা চালাইয়া আস্তে আস্তে শোধ করা লাগবে।’

ঢাকার নবাবগঞ্জে রিকশা গ্যারেজে থাকা আয়নাল হোসেনের প্রশ্ন- ‘কাপড়-চোপড় ছাড়াও তো ঈদে আরও খরচ আছে। কেউ যদি দই চিড়া খায়, আমারতো চিড়া খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। না করতে পারলে যামু ক্যামনে?’

জামালপুরের ইসলামপুরের বেনুয়ার চরের শাহ আলম ঢাকায় প্রায় ২০ বছর ধরে রিকশা চালান। তবে টানা রিকশা চালাতে পারেন না। ২০ দিন রিকশা চালালে ১০ থেকে ১৫ দিন গ্রামে থাকতে হয় বিশ্রামের জন্য। ওই সময় গ্রামে গরু চড়ান। শাহ আলমের চার মেয়ে, এক ছেলে। কেউ কলেজে, কেউ স্কুলে পড়ে; তবে তার সব ছেলে-মেয়েই পড়াশোনা করছে বলে জানান।

বাড়ি ভিটা ছাড়া বাড়তি কোনো জমি না থাকা শাহ আলম বলেন, ‘ঈদে ছেলে-মেয়েগো কী দিমু, হেইডা চিন্তা করতাছি দেইখাই আইছি। আইছি (ঢাকা আসছেন) গত পরশু দিন। আমার একার ওপরেই সব। ঈদের আগে আগে বাড়ি যামু। ঈদে আমরা খরচ না করলেও চলে, পুলাপানের (ছেলে-মেয়ে) তো চলে না।’

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের চামড়াবন্দর এলাকার মানুষ তোতা মিয়া। ২০ থেকে ২২ বছর ধরে ঢাকা শহরে রিকশা চালান। তার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। ঈদের কেনাকাটা ও খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘টাকা-পয়সা তো জোগাড় হয় নাই, সামনে যে কয়দিন আছে, জোগাড় অইয়া যাব।’

তোতা মিয়া বলেন, ‘আমরা কৃষক মানুষ। মনে করেন, ১০ দিন গাড়ি চালাইয়া যাইগা। বাড়িত জমিজমা আছে, গরু-বাছুর আছে, এগুলার খেয়াল রাখি। এবার তো গিরস্তির মাইর গেছে, ধান অইছে না। অনেক জমিন কাডাই (ধান কাটা) অইছে না। কাডাইয়া জমিন পুষে না। যে টাকার কাডা পড়ে, হেই টেকার (টাকা) ধানই অয় না। তাই জমির ধান অহনও ক্ষেতেই রইছে অনেক।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমারও এইরহম অইছে। আমি কাডাইছি। আর কিছু থুইয়া দিছি। এক লোকে জমিন কাডাইছে ১৫ হাজার টেকা দিয়া। হেই জমির ধান বেচ্চে (বিক্রি করছে) ১১ হাজার ৫৩০ টেকা (টাকা)। সাড়ে তিন হাজার টেকা ওই ব্যাডার (লোকের) লজ গেছে।’

দুপুরে গাছের ছায়ায় রিকশার উপর বসে ফোনে কথা বলছিলেন দিনাজপুরের চিরির বন্দর থেকে আসা রিকশাচালক আইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এহনই ফোন দিছিলাম। মেয়ে ঘুমাইছে, কথা হয়নি। এখন ওয়াইফের (স্ত্রী) সঙ্গে কথা বললাম।’

আইনুল ইসলামের দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছোটজন বাদে দু’জনই স্কুলে যায়। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ঈদ করতে পারবেন কি-না জানেন না আইনুল। প্রতিদিন ১০০ টাকা জমা এবং থাকা-খাওয়ার জন্য আরও ১২০ টাকা জমা দিতে হয় তার। বাকি যা থাকে তা বাড়িতে পাঠান।

ঈদে বাড়ি যাওয়ার বিষয়ে আইনুল ইসলাম বলেন, ‘এখনও কনফার্ম (নিশ্চিত) না। পয়সা-কড়ি যদি ভালো কামাই হয় তাহলে যাব। কামাই যদি ভালো না হয়, তাহলে গিয়ে কী করব। ঈদের সময় যেতেও তো ১০০০ টাকার টিকিট লাগে। দেহা যাক, ঈদের পরেই মনে অয় যামু।’

পিডি/আরএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।