ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ তুমি কার?
২০১৫ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড তাদের ব্যান্ডউইথের দাম কমিয়েছে। দাম কমানোর হারটা শতকরা ৪১ ভাগ বলে ইন্টারনেট গ্রাহকদের মাঝে এমন প্রত্যাশার জন্ম হয়েছে যে তারা এই দাম কমার উপকারটা পাবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি কতোটা পাওয়া যাবে তার বিষয়ে সচেতন মহলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
ব্যান্ডউইথের দাম কমানো বিষয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠের খবর হচ্ছে; “ব্যান্ডউইথের দাম আরেক দফা কমিয়ে প্রতি ১ এমবিপিএস (মেগাবাইট পার সেকেন্ড) ৬২৫ টাকা করা হয়েছে, যা আজ (১লা সেপ্টেম্বর ১৫) থেকে কার্যকর হচ্ছে। আগে ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের দাম ছিল এক হাজার ৬৮ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম কমেছে ৪৪৩ টাকা।” একই পত্রিকার খবরে আরও বলা হয়েছে যে, “ব্যান্ডউইথ সরবরাহে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কম্পানি (বিএসসিসিএল) পাইকারি পর্যায়ে ব্যান্ডউইথের দাম ব্যাপক হারে কমিয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহার আরো সাশ্রয়ী করতে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আট দফায় ব্যান্ডউইথ চার্জ কমানো হয়েছে। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে প্রতি এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের মূল্য ছিল ২৭ হাজার টাকা, যা ২০১৫ সালে এসে ৬২৫ টাকা হয়েছে।”
ব্যান্ডউইথের দাম বিষয়ে দৈনিক প্রথম আলোর ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় বলা হয়েছে, “ব্যান্ডউইথের দাম যেভাবে বিএসসিসিএল নির্ধারণ করেছে সেটা হলো: ৫০ থেকে ৯৯৯ এমবিপিএস ৯০০ টাকা। ১০০০ থেকে ২৪৯৯ এমবিপিএস ৮২৫ টাকা, ২৫০০ থেকে ৪৯৯৯ এমবিপিএস ৭৫৫ টাকা, ৫০০০ থেকে ৯৯৯৯ এমবিপিএস ৬৮০ টাকা এবং ১০০০০ এমবিপিএস (১০ জিবিপিএস। ১০২৪ এমবিপিএস ১ জিবিপিএস) এবং এর চেয়ে বেশি ব্যান্ডউইথ কেনার ক্ষেত্রে প্রতি এমবিপিএসের দাম পড়বে ৬১৮ টাকা। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান কৌশল কর্মকর্তা (সিএসও) সুমন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে শুধু গ্রামীণফোনেরই ১০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইটথের চাহিদা রয়েছে। আর কোনো ইন্টারনেটসংযোগদাতাই এই ধাপের শর্ত পূরণ করে ৬১৮ টাকায় ব্যান্ডউইথ কিনতে পারবে না। বেশির ভাগ সংযোগদাতা পরবর্তী দরের ব্যান্ডউইথ কিনবেন।’
আইআইজিকে সরকারের সঙ্গে ১০ শতাংশ রাজস্ব ভাগাভাগি করতে হয়। এরপর মূল্য সংযোজন কর এবং নিজেদের লাভের হিসাব রয়েছে। তাই বিএসসিসিএলের ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে আইএসপির কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করবে আইআইজিগুলো। ব্যান্ডউইথের এ দাম কমানোর ফলে গ্রাহক খুব একটা লাভবান হবেন না বলেই মনে করেন সুমন আহমেদ। ইন্টারনেট সংযোগদাতাদের সংগঠন আইএসপি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি এম এ হাকিম বললেন, ‘ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএসপিগুলোর যে খরচ হয়, তার একটা ক্ষুদ্র অংশ ব্যান্ডউইথ কেনা। এর বাইরে গ্রাহকের কাছে সংযোগ পৌঁছে দেওয়ার অবকাঠামো, পরিচালন ব্যয় ইত্যাদির খরচই বেশি। আইএসপির মোট খরচের মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ ব্যয় হয় ব্যান্ডউইথের জন্য।’
ইন্টারনেটের দাম কমছে না, তবে গ্রাহক কি বেশি গতি পেতে পারেন? এম এ হাকিম বলেন, ‘গতি এলেও এই অবস্থায় বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। হয়তো ১২৮ বা ২৫৬ কেবিপিএস গতি বাড়তে পারে, এর বেশি নয়। ১০ জিবিপিএস কিনতে বিএসসিসিএলকে প্রতি মাসে দিতে হবে ৭২ লাখ টাকা। এর বাইরে আবার দুই মাসের অগ্রিম টাকাও দিতে হবে।”
দুটি পত্রিকার খবরে ১০ জিবির দামে দুরকম বলা আছে; ৬২৫ ও ৬১৮। তবে সংশ্লিষ্টরা যেসব কথা বলেছেন এবং প্রথম আলোতে দামের যে বিবরণটি দেয়া আছে তাতে দাম নির্ধারণে শুভঙ্করের ফাঁক আছে সেটি বোঝা যায়। বস্তুতপক্ষে ২৭ হাজার টাকার সাথে ৬২৫ (বা ৬১৮) টাকা তুলনীয়ই নয়। তবে পূর্ববর্তী দাম ১০২৮ টাকার সাথে তুলনা করলে এই মূল্যহ্রাস শতকরা ৪১ ভাগ। তবে এই ৪১ ভাগ মূল্যহ্রাসের সুবিধা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা পাবে তেমন কোনো ভরসাই কোনো মহল করছে না।
প্রথমত এই মূল্যহ্রাসের মাঝে একটি শুভংকরের ফাঁক আছে। ক) শতকরা ৪১ ভাগ মূল্যহ্রাস কার্যত কেবলমাত্র ১০ জিবি গতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। যেখানে সারা বাংলাদেশ মাত্র ৩০ জিবি ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে সেখানে একটি বড় মোবাইল অপারেটর ছাড়া আর কেউ যে সেটি নিতে পারবে না এটিই বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এতে মনে হতে পারে যে সেইশহরের লোকেরা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সম অধিকার কেন পাবেনা? কেন তাদের জন্য এনটিটিএন চার্জসহ ব্যান্ডেইথের মূল্য প্রযোজ্য হবে? গ) যারা এই মূল্যহ্রাস ব্যবহার করতে চাইবেন তাদেরকে পুরো এক বছরের জন্য চুক্তি করতে হবে।
ব্যবহার যাই হোক না কেন পুরো ১০ জিবির দামই ক্রেতাকে দিতে হবে। দুই মাসের অগ্রিম ভাড়াও দিতে হবে। বস্তুত এই দাম ১ জিবির জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত ছিলো। এই প্রেক্ষিতে খবরে আরও বলা হয়েছে, “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘মানুষের দোরগোড়ায় ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে সরকার ব্যান্ডউইথের দাম পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে এবং বাংলাদেশকে জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির দিকে নিয়ে যেতে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ জন্য ভয়েস কলের মতো ইন্টারনেটেরও ন্যূনতম দর নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে সরকার।’
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী রেগুলেটর প্রতিষ্ঠান বিটিআরসি চেয়ারম্যানকে এনটিটিএন (ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক), আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) এবং মোবাইল অপারেটরদের নিয়ে বসে দ্রুত গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যান্ডউইথের দাম আমাদের ইন্টারনেট সেবা প্রদানের মোট খরচের একটি ক্ষুদ্র অংশ। তাই এর দাম কমলে তা খরচে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটায় না। তবু এ বছর আমরা গড় ইন্টারনেটের চার্জ ৫৬ শতাংশ হ্রাস করেছি।’
অপারেটরদের দাম কমানোর বিষয়টির প্রত্যক্ষ ফলাফল আর যাই হোক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যে পাননা সেটি বলারই অপেক্ষা রাখেনা। বিশেষ করে মোবাইল অপারেটররা নানা ধরনের প্যাকেজের ফাঁদে ফেলে ব্যবহারকারীদের পকেট কেটেই চলেছে। শেয়ারড ব্যান্ডউইথ দিয়ে ডাটার প্যাকেজ বানিয়ে এক এমবিপিএস গতির ডাটাকে তারা কিলোবাইট, মেগাবাইট, গিগাবাইট হিসেবে বেচে। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ১৭ গুণ মুনাফা করে। বিশেষ করে প্যাকেজ শেষ হয়ে যাবার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে যখন কিলোবাইট হিসেবে ডাটা চার্জ করা হয় তখন আর রক্ষা নাই। প্রিপেইডের ব্যালেন্স শেষ হয় আর পোস্টপেইডে ভুতুড়ে বিল আসে। একজন ভোক্তা হিসেবে আমি ব্যান্ডউইথ-এর গতির ওপর চার্জ দেবার অধিকার রাখি। ১ এমবি, ৫১২ কে বা ২৫৬ কে হিসেবে আমাকে চার্জ করা হতে পারে।
অথচ কোনো থ্রিজি অপারেটর ব্যান্ডউইথ-এর গতিতে চার্জ করে না। তারা ডাটা হিসেবে চার্জ করে। অথচ আমার ডাটার ওপর কোন সীমানা থাকতে পারেনা। আমার প্রাপ্য গতি অনুসারে আমি আমার যতো খুশি ডাটা ব্যবহার করবো। কিন্তু মোবাইল অপারেটররা সেটির তোয়াক্কা না করে গ্রাহকদেরকে ঠকাচ্ছে। আবার যদি আনলিমিটেড প্যাকেজ নেয়া হয় তখনও ফেয়ার ইউসেজ পলিসির নামে ৩০ জিবিতেই আনলিমিটেড শেষ হয়ে যায়। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কোনো পথ নাই। বিটিআরসিও এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ক্যাবল লাইনের ইন্টারনেটে যেহেতু চলতি পথে ব্যবহার করা যায় না সেহেতু বাধ্য হয়েই সবাইকে থ্রিজি সেবা নিতে হয়। অন্যদিকে দেশের প্রায় সকল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীইতো মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তাদেরতো মোবাইল অপারেটর ছাড়া অন্য কারও কাছে যাবারও উপায় নেই।
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জুন মাস নাগাদ মোট ইন্টারনেট গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৮৩ লাখ ৪৭ হাজারে। এর মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহকসংখ্যা চার কোটি ৬৮ লাখ ৯৯ হাজার, যা গত বছর এই সময়ে ছিল তিন কোটি ৬৪ লাখ ১২ হাজার। দেশে এক বছরে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে এক কোটি চার লাখ ৮৭ হাজার। বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।
এই তথ্যাবলীর পাশাপাশি এটিও মনে রাখা দরকার যে থ্রিজি বা ক্যাবলের পরিধিটা এখনও বাংলাদেশের উপজেলা স্তরেও যায়নি। ফলে এখনও দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা গতির সাথে পরিচিত হতে পারেনি। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোর চরম দুর্গতি হচ্ছে ইন্টারনেট পেতে। কিন্তু কে রাখে তাদের খবর।
আমি মনে করি দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের প্রসার ঘটাতে না পারলে এবং ইন্টারনেটকে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতায় না আনতে পারলে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সকল উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৬ আগস্ট ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভায় সে নির্দেশই দিয়েছেন। কিন্তু তার সরকারেরই অনেকে তার নির্দেশ মানেন না বা বোঝেন না। কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করেন।
লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক । [email protected], www.bijoyekushe.net, www.bijoydigital.com
এইচআর/এমএস