যেভাবে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিলো এই চক্র
আসাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. বাশার। তানভীর নামের একজনের মাধ্যমে তিনি বিদেশি শাটিং ফেব্রিক্স কিনতে রাজি হন। নিজে গাজীপুরে একটি গোডাউনে মালামালও দেখে আসেন। এরপর মহাখালীর ডিওএইচএস এলাকার একটি অফিসে গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তিতে ১০ লাখ টাকার চেক দেন।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে বসে আরও ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন। কিন্তু মালামাল আনতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন ওই মালামালের মালিক অন্য কেউ। তানভীরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে প্রাণনাশ ও মামলার হুমকি দেয়া হয়।
মো. বাশার জাগো নিউজকে বলেন তার এমন ফাঁদে পড়ার কথা। এভাবে ফাঁদ পাতে একটি প্রতারকচক্র। রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসে চক্রটির বিলাসবহুল অফিস। চট্টগ্রাম বন্দরেও রয়েছে ভিআইপি অফিস। যেখানে ম্যাগনেটিক কয়েন, ম্যাগনেটিক পিলার, তক্ষক, শাটিং ফেব্রিক্স কাপড় এবং জাহাজের স্ক্র্যাব ও লোহার গর্দা কম দামে বিক্রির কথা বলে চুক্তি হয়। এরপর বিদেশি গ্রাহক সংগ্রহ করে দেয়ার কথা বলে সচ্ছল ও ব্যবসায়ীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে চক্রটি। বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ও ভুয়া প্রমাণ রিপোর্ট দেখিয়েও চক্রটি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে। এ প্রক্রিয়ায় গত ২০ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্রটি।
সাড়ে ৩০ লাখ টাকা খোয়া যাওয়ার পর মো. বাশার অভিযোগ করেন র্যাবের কাছে। এরপর বুধবার রাতে রাজধানীর কাফরুল এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক চক্রটির ১৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব-৪ ব্যাটালিয়ন। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন নথিপত্র ও ৩২টি মোবাইলফোন জব্দ করা হয়।
গ্রেফতাররা হলেন- নুরুল ইসলাম (৩৭), মিনার মিয়া (৪২), মিজান (৫০), তোফাজ্জল করিম ওরফে তানভীর (৪১), আক্তার ফারুক (৪৩), রাজু (৪১), গোলাম মোস্তফা শাকিল (৪২), শাকিল খান (৩০), জাহাঙ্গীরুল আবেদীন (৪৫), আজগর আলী হাওলাদার (২৭), সিরাজুল ইসলাম (৪৫), শামিম মিয়া (৪০), অজয় চাকী (৪০), হারুন উর রশিদ (৪৭) ও তুষার আহমেদ (২০)।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর জাগো নিউজকে বলেন, গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণার মামলা রয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে চক্রটির প্রতারণার অফিস রয়েছে।
তিনি বলেন, কয়েক স্তরে প্রতারক চক্রটি সক্রিয়।
প্রতারক চক্রটির মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের বলা হয় এজেন্ট। দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আর্থিক সচ্ছল ও ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে গ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গ্রাহকদের কাছে বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দেন প্রতারকরা। মালামাল বিক্রয়ের লোভনীয় অফার এবং বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষিত মালামাল নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজনের যোগসাজশে নিজেদের মালামাল হিসেবে উপস্থাপন করেন তারা।
স্থানীয় ব্রোকার প্রতারক চক্রের সংক্রিয় সদস্য। টার্গেট গ্রাহকদের মালামাল দেখানোর জন্য এজেন্টরা নিয়ে গেলে স্থানীয় ব্রোকাররা নিজেদের সরকারি দলের উচ্চপদের নেতা অথবা কোনো রাজনৈতিক নেতার ভাই, নিকটাত্মীয় বলে পরিচয় দেয়। ব্রোকার গ্রাহকদের সঙ্গে পরিচয়ের পর মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়ে কথা বলে। চক্রের মালামালকে নিজেদের মালামাল উল্লেখ করে তা বিক্রির কথা জানায়। মালামাল ক্রয়ে চুক্তির জন্য চক্রের অফিস রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএস এলাকায় নিয়ে যায় গ্রাহকদের। অফিসের অভ্যর্থনা কক্ষে সুন্দরী ও স্মার্ট মেয়েদের বসিয়ে টার্গেটদের প্রভাবিত করা হয়।
ম্যানেজার প্রতারণা চক্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টার্গেট গ্রাহকরা অফিসে আসার পর ম্যানেজার সুকৌশলে প্রভাবিত করে মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের ভুয়া চুক্তিনামা তৈরি, অগ্রিম টাকা গ্রহণ করে কথিত কোম্পানির পক্ষে মানি রিসিট দেয়।
এমডি বা চেয়ারম্যান এ চক্রের অন্যতম হোতা। রাজধানীর বিভিন্ন নামি-দামি এলাকায় অফিস ভাড়া নেয় চক্রটি। গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়। পরিস্থিতি বুঝে কখনও অফিস পরিবর্তন করে, কখনও একই অফিসেই অন্য ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে কার্যক্রম শুরু করে।
প্রতারণার কৌশল : শাটিং ফেব্রিক্স বিক্রির নামে প্রতারণা
প্রতারকচক্রের এজেন্ট বিভিন্ন কাপড় ব্যবসায়ীকে টার্গেট করে কার্যক্রম শুরু করে। তারা প্রথমে ভুয়া কোনো গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির এজেন্ট হিসেবে ব্যবসায়ীদের দোকানে গিয়ে তাদের প্রয়োজনমতো কম দামে শাটিং কাপড় বিক্রির লোভনীয় অফার দেয়। কয়েক হাজার গজ কাপড় বিভিন্ন স্থানে ফ্যাক্টরির গোডাউনে রাখা আছে বলে জানায়। ব্যবসায়ীরা লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে গোডাউনে রাখা শাটিং ফেব্রিক্স দেখে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ও মালামাল ক্রয়বাবদ অগ্রিম টাকা দেয়। পরে মালামাল আনতে গিয়ে জানতে পারেন, ভুয়া কোম্পানির মানি রিসিট দেয়া হয়েছিল তার হাতে। পুরো প্রক্রিয়ায় তিনি প্রতারিত হয়েছেন। একই প্রক্রিয়ায় জাহাজের স্ক্যাব ও পুরান লোহালক্কর লোভনীয় অফারে বিক্রির কথা বলে ভুয়া চুক্তি ও অগ্রিম বাবদ নগদ টাকা গ্রহণ করে চক্রটি।
পাওয়ার কয়েন ও ম্যাগনেটিক পিলার বিক্রির নামে প্রতারণা
প্রতারকচক্রের সদস্যরা দেশের আর্থিক সচ্ছল ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ চাকরিজীবীদের টার্গেট করে পুরনো যুগের বিশেষ ধরনের কয়েন মহামূল্যবান, যাহার মূল্য প্রায় কয়েক শত কোটি টাকা বলে প্রচার করে। কয়েনগুলো বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রমাণস্বরূপ তারা ভুয়া রিপোর্ট দেখায়। কয়েনের ওপর তারা বিশেষ ধরনের ক্যামিকেল প্রয়োগ করে তার ওপর ২৪-২৫ পিস ধান রেখে বিভিন্ন রঙ ধারণপূর্বক একপর্যায়ে ধুলায় পরিণত করে দেখায়। কয়েনের ক্ষমতা দেখে প্রভাবিত হয় গ্রাহক। আরেক কথিত বিশেষজ্ঞকে ডেকে সাধারণ ও অসাধারণ কয়েন চিহ্নিত করে দেখায় চক্রটি। কয়েন বিদেশি গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে বুঝতে পারেন তাও ভুয়া। পাওয়ার কয়েনের মতো প্রায় একই প্রক্রিয়ায় টার্গেটদের কাছে ম্যাগনেটিক পিলার কম দামে বিক্রি করে প্রতারণা করে চক্রটি।
২৫৩ গ্রাম ওজনের তক্ষক হলেও দাম ২০০ কোটি টাকা!
প্রতারকচক্রটির প্রতারণার আরেকটি ফাঁদ হলো তক্ষক। ১৫ ইঞ্চির বড় ও কমপক্ষে ২৫৩ গ্রাম ওজনের তক্ষকের মূল্য ১০০ থেকে ২০০ কোটি টাকা। কম দামে তারা তক্ষক সরবরাহ করবে এবং বিক্রির জন্য বিদেশি গ্রাহকও সংগ্রহ করে দেয়ার কথা বলে রাজি করে ভিকটিমদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়।
জেইউ/জেডএ/এমকেএইচ