আদালতের আদেশকে তোয়াক্কা করলেন না এক শিক্ষা কর্মকর্তা


প্রকাশিত: ১১:২২ এএম, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শিক্ষা কর্মকর্তার একগুয়েমির কারণে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার যাদুরচর উচ্চ বিদ্যালয় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি বিধি-বিধান উপেক্ষা করে প্রধান শিক্ষক মাজেদুল ইসলামকে গায়ের জোরে বাদ দেয়া হয়। আর জুনিয়র সহকারী শিক্ষক আতিউর রহমানকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ফলে তিন বছর ধরে মামলা জটিলতায় স্কুলের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়ে পড়েছে।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ ব্যাপারে নির্দেশ দিলেও তা উপেক্ষা করা হয়। এই অপকর্মের হোতা আতিউর রহমান। তিনি উপজেলা শিক্ষা অফিসার রেজাউল কবির, দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক রবীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, জেলা শিক্ষা অফিসার ও রৌমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের যোগসাজসে এসব অপকর্ম পরিচালনা করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রৌমারী যাদুরচর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হজরত আলীর ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি ওই বছর ৩০ জানুয়ারির বিধি মোতাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক মাজেদুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করে। এর কয়েকদিন পর তৎকালীন জেলা শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম স্বাক্ষরিত একপত্রে সহকারী জুনিয়র শিক্ষক আতিউর রহমানকে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক উল্লেখ করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব প্রদানের জন্য স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতিকে নির্দেশ দেন। তার এই অন্যায় আদেশে ক্ষুব্ধ হয়ে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচনের জন্য কুড়িগ্রাম সহকারী জজ আদালতে মামলা দায়ের করা হয়।

এরপর ৭ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে আদালত মাজেদুলকে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে রায় দেয়। আর এই রায়ের বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল দায়ের করেন আতিউর রহমান। এখানেও নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখা হয়। এরপর এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের সিভিল রিভিশন দায়ের করেন আতিউর।

১৮ জুন ২০১৪ হাইকোর্ট তার এ আবেদন নামঞ্জুর করেন। পরে সুপ্রিম কোর্টেও ওই আদেশের বিরুদ্ধে ৭২৪/২০১৪ নং সিভিল মিসক্লিনিয়াস আপিল দায়ের করেন তিনি। ০৩/০৭/২০১৪ শুনানি অন্তে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আতিউরের উপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখেন এবং স্টাটাস কোর্ট আদেশ প্রদান করেন। এরপরও আতিউর রহমান উপজেলা শিক্ষা অফিসার রেজাউল কবির ও দিনাজপুর বোর্ডের পরিদর্শক রবীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্জ পারস্পরিক যোগসাজসে নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে।

শিক্ষক মাজেদুল ইসলাম জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্র স্মারক নং- শিম/শা-১৩/এমপিও-১২/২০০৯(অংশ)/২০৭; তারিখ ২৭ আগস্ট ২০১২ এর ১৩ নং ক্রমিকে বর্ণিত জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ব্যবস্থপনা কমিটি আমাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করে। কিন্তু দুই মাস পর সহকারী শিক্ষক আতিউর রহমান যোগসাজস করে পাল্টা ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের অপতৎপরতা চালায়। ফলে ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদন নিয়ে আমি আদালতের আশ্রয় নেই। নিম্ন আদালত আমার পক্ষে রায় দিলে তারা চ্যালেঞ্জ করে।

পরে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টও আমার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু উপজেলা শিক্ষা অফিসার রেজাউল কবির আদালতের রায় উপেক্ষা করে প্রধান শিক্ষক নিয়োগে ডিজির প্রতিনিধিসহ গোপনীয়তা রক্ষা করে অবৈধভাবে বিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠতার বিচারে ৪নং শিক্ষক আতিউর রহমানকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করেন। চার লাখ টাকা দফারফা হওয়ায় তিনি আতিউর রহমানের পক্ষ নিয়েছেন বলে শুনেছি।

এ ব্যাপারে শিক্ষক আতিউর রহমান জানান, তৎকালীন জেলা শিক্ষা অফিসার ও দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড পরিপত্র যাচাই-বাছাই পূর্বক নিয়োগ বিধি মেনে আমাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের রায় সম্পর্কে শুনেছি কিন্তু পুরো বিষয়টি জানিনা।

তিনি এ দাবি করলেও কাগজপত্র থেকে জানা যায়, প্রতিটি আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আতিউর রহমান নিজে আপিল করেন। এছাড়াও হাইকোর্ট থেকে কনটেমপ্ট পিটিশনের পর বেতন-ভাতা গ্রহণে রুল জারি করা হয়। আর তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে কেনো বেতন উত্তোলন করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা আদালতে জবাব দাখিল করেছি। বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। কাজেই বেতন ভাতা উত্তোলন অবৈধ ছিল না।

রৌমারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার রেজাউল কবির জানান, আদালত কি করেছে সেটা আদালতের বিষয়। এ রকম বহু রায় আমরা পায়। যা পরিপত্র অনুযায়ী ঠিক থাকে না। আমারও নিজস্ব জাজমেন্ট রয়েছে। পরিপত্র অনুয়ায়ী আমরাও কাজ করতে পারি। ম্যানেজিং কমিটি এসপার রুল অনুযায়ী কাজ করেছে। মামলা মামলার মত চলবে, নিয়োগ নিয়োগের মতো চলবে। এখন রায় মাজেদুলের পক্ষে গেলে আালতের বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার আমাদের নাই।

তৎকালীন জেলা শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের আলোকে মাজেদুলকে নিয়োগ প্রদানের দুই মাস পর জ্যেষ্ঠতার বিচারে আতিউর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিতে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতিকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু সে সময় তারা জ্যেষ্ঠতার সঠিকতা নিয়ে আদালতে মামলা করে। পরবর্তীতে বদলি জনিত কারণে অন্য জেলায় যাওয়ায় এ ব্যাপারে আমার কাছে কোন তথ্য নেই।

বর্তমান জেলা শিক্ষা অফিসার ভবো শংকর জানান, যাদুরচর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের জ্যেষ্ঠতা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে মামলা চলছে। সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রায় আমার হস্তগত হয়েছে। আদালতের রায় মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক রবীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য জানান, আমি তদন্তে আতিউর রহমানকে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে রিপোর্ট দিয়েছি। সহকারী জজ আদালত, জজ আদালত ও হাইকোর্টের রায়ে মাজেদুলকে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ঘোষণা দেয়ার পরও কেন শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, এ প্রশ্নে তার সাফ জবাব-প্রতিটি আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল থাকায় তা আমলে নেয়া হয়নি। হাইকোর্ট থেকে তার নামে কোর্ট অবমাননার (কনটেম্পট) রুল জারি সম্পর্কেও তিনি অবগত নন বলে জানান।

নাজমুল হোসেন/এআরএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।