আয়নাবাজি আমাদের চেনা মানুষের গল্প


প্রকাশিত: ১০:৪২ এএম, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সংস্কৃতি অঙ্গনে তাঁর আগমন মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে। তবে তিনি জনপ্রিয়তার পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন টিভি নাটক ও বিজ্ঞাপন দিয়ে। পরে চলচ্চিত্রও তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। গানের ভুবনেও রয়েছে তার সফল পদচারণা। বলছি সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর কথা।

পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। ১৯৯৬ সালে তিনি অভিনয় জীবন শুরু করেন। সেসময় তিনি ‌‘আরন্যক’ নাট্যদলে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অসংখ্য জনপ্রিয় নাটক দর্শকদের উপহার দিয়েছেন তিনি। ২০০৯ সালে গিয়াস উদ্দীন সেলিম পরিচালিত ‘মনপুরা’ এরপর ২০১০-এ গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’, ২০১৩ সালে মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’- এ কাজ করে প্রশংসিত হয়েছেন।

সম্প্রতি শেষ করলেন অমিতাভ রেজার পরিচালনায় ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রে কাজ। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই অভিনেতা সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলেন জাগোনিউজের। সঙ্গে ছিলেন নাহিয়ান ইমন

জাগোনিউজ : গেল ঈদে আপনার অভিনীত নাটক কম প্রচারিত হয়েছে। কেন বলুন তো?
চঞ্চল : রোজা ঈদে আমার নাটক কম প্রচারিত হয়েছে। কারণ আমি ‘আয়নাবাজি’ ছবিটি নিয়ে পুরোদস্তুর ব্যস্ত ছিলাম। সেজন্য অন্যকাজ একেবারে করিনি বললেও চলে। তবে ‘ইয়ার আলীর নতুন বউ’ নামে একটি ছয় পর্বের নাটক আরটিভিতে প্রচারিত হয়েছিলো। ওই কাজটি করে বেশ মজা পেয়েছিলাম। এর সাড়াও পেয়েছি ভালো।

জাগোনিউজ : আয়নাবাজির গল্প শুনতে চাই...
চঞ্চল : আয়নাবাজি আমাদের খুব কাছের মানুষের গল্প। এখানে আমাকে দেখা যাবে ‘আয়না’ ভূমিকায়। ছবির গল্পে দেখা যাবে শহরের ভিতরে আরো একটা শহর। যার গল্প এখন আমরা আর শুনি না। ‘আয়নাবাজি’ সেই শহরের গল্প শুনাবে। যে শহরে এখনও সকালে দুধওয়ালা আসে, ফেরিওয়ালারা হাঁকডাক দেয়, বাচ্চারা দল বেঁধে নাটক শিখতে যায়। মহল্লার পুরীর দোকানে চা খাওয়া হয়, ঠাট্টা-মশকরা করে বেকার সব বখাটেরা।

আয়না সেই শহরের একজন বাসিন্দা। সহজ আর সরল। সেখানে তার একাকী জীবন আর ছোট বাচ্চাদের নিয়ে একটা নাটকের দল। তারই মাঝে হঠাৎ একদিন একটা সহজাত প্রেম হয়ে যায় হৃদি নামের এক মেয়ের সাথে। নতুন জীবনের আহ্বানে সে নতুন শহরে আসে। কিন্তু মুখোশ পাল্টিয়ে, অন্য মানুষ হয়ে, চেনা কিছু মানুষের ডাকে।

Chanchal - Aynabaji
সেই মানুষগুলোর জন্য আয়না কাজ করে জীবিকার প্রয়োজনে, তারপর ফিরে যায় তার ছোট্ট মহল্লায়। এরকম আসা-যাওয়ার মাঝে কখনো আটকে পড়ে নষ্ট শহরের বেড়াজালে। বের হয়ে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারে না আয়না। পারে না তার মহল্লার আয়না হতে। রঙিন মুখোশ আর খুলতে পারে না সে।

জাগোনিউজ : তবে কী আয়নার ফেরা হয় না আর?
চঞ্চল : না। আয়না তার ফেলে আসা প্রেম আর নাটকের স্কুলের কাছে যেন আর ফিরে যেতে পারে না। যে অভিনয়কে ভালোবেসে আয়না এই শহরকে মঞ্চ বানাতে চায়, সেই মঞ্চ একদিন হয়ে যায় ফাঁসির মঞ্চ।

জল্লাদের হাসির কাছে এই শহরের সেরা অভিনেতা পরাজয়ের শেষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে। এই যুগের স্পার্টাকাস আয়না যেন তার শেষ নাটকের মঞ্চে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে মানুষখেকো মানুষগুলোর। এমনই অনুভূতি নাড়া দেয়ার গল্প নিয়ে তৈরি হচ্ছে আয়নাবাজি ছবিটি। আসলে ছবিটি না দেখলে অনুধাবন করা যাবে না এর আবেদন।

জাগোনিউজ : এ ছবিতে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
চঞ্চল : আয়নাবাজিতে কাজের অভিজ্ঞতা অসাধারণ। সারা জীবন মনে থাকবে আয়না চরিত্রে শুটিং করার দিনগুলির কথা। অনেক মজার স্মৃতি আছে, গল্প আছে। ছবির পরিচালক অমিতাভ রেজা একজন অসম্ভব মেধাবী নির্মাতা। তিনি খুব তীক্ষ্ণতার সাথে এ ছবির পুরো টিমের কাছ থেকে সেরা কাজ আদায় করে নিয়েছেন। তাছাড়া এ ছবির চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামানও খুব ভালো কাজ করেছে। অন্যান্যরাও কাগের ক্ষেত্রে সিরিয়াস ছিলো। এবার দর্শকদের ভালোবাসার অপেক্ষায় থাকলাম। তাদের কাছ থেকে সাড়া পেলেই আয়নাবাজি সাকসেসফুল হবে।

জাগোনিউজ : ছবির শুটিং চলাকালে বিশেষ কোনো ঘটনা যদি শেয়ার করতেন...
চঞ্চল : দৃশ্যের প্রয়োজনে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের ভিতর কয়েদীদের সাথে কাজ করেছি। যেটা এবারই প্রথম করেছি। সেখানে কারাগারের ভিতর শুটিং করার সময় অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। এছাড়া পুরান ঢাকা-কেরানীগঞ্জসহ অনেক রিয়েল লোকেশনে শ্যুটিং করেছি। যা আগে করিনি। খুব ভালো লেগেছে।

Chanchal - Aynabaji 2
জাগোনিউজ : শুনেছি এ ছবির জন্য নাকি ওজনও কমিয়েছেন?

চঞ্চল : আয়নাবাজিতে সাত-আটটি চরিত্রে আমাকে দেখা যাবে। যার কারণে একেকটি চরিত্রে আমার গেটআপ, মেকআপ এবং কসটিউম সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলো। চরিত্রের প্রয়োজনে প্রায় ১৫ কেজি ওজন কমিয়েছি। প্রত্যেকটি চরিত্রই ভিন্ন ভিন্নভাবে তুলে ধরতে হয়েছে। এ কারণে খানিকটা বেগও পেতে হয়েছে আমাকে।

জাগোনিউজ : এ ছবিতে আপনার বিপরীতে রয়েছে নাবিলা। সে কেমন কাজ করেছে?
চঞ্চল : উপস্থাপনায় নাবিলা খুব জনপ্রিয়। চলচ্চিত্রে এবারই প্রথম সে কাজ করল। ওকে নিয়ে পরিচালক প্রথমে ভয় পেলেও নাবিলা অসাধারণ কাজ করেছে। এখানে সম্পূর্ণ অচেনা এক নাবিলাকে দেখবে দর্শক। অভিনয়ের প্রতি ওর ভক্তি, ডেডিকেশান আমার ভালো লেগেছে।

জাগোনিউজ : ছোটপর্দা ও বড়পর্দায় একসাথে কাজ করলে তাতে সমন্বয় থাকে বলে আপনি মনে করেন?
চঞ্চল : একজন প্রকৃত অভিনেতাকে বিচার করার মাপকাটি এখানেই। আমি প্রায় ২৫ বছর হলো অভিনয় করছি। অভিনয়শিল্পী মানেই হাল না ছাড়া। তবে হ্যাঁ, একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিজের জাত চেনানো উচিত। কাজটি অনেক আগেই খানিকটা শেষ করেছি। তাই এখন সব জায়গার জন্যই প্রস্তুত আমি। আমার কোনো সমস্যা হয় না।

জাগোনিউজ : কিন্তু দর্শক আপনাকে চিত্রনায়ক নাকি ছোট পর্দার নায়ক বলবেন?
চঞ্চল : আমি আসলে দর্শকদের জন্যই কাজ করি। জানি না তাদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তৈরি হয়েছে। তবে বেঁচে থাকতে হলে নিত্য প্রয়োজনটুকু যেমন মেটাতে হয় তেমনই অভিনয় করে দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্ট করি। আমি মনে করি না তাদের এতে কোনো সমস্যা হবে। কোনো নায়ক নয়, আমি একজন অভিনেতা হিসেবেই সবার কাছে ভালোবাসা পেতে চাই।

Chanchal - Monpura
জাগোনিউজ : আপনাকে আঞ্চলিক ভাষার নাটকেই বেশি অভিনয় করতে দেখা যায়। কিন্তু কেন?

চঞ্চল : আমার কাছ থেকে নাট্যকার, পরিচালক যেভাবে অভিনয় চান আমি সেভাবেই কাজ করি। আমার পেশা বলতেই তো অভিনয়। কাজ না করলে দিন-পথ কী করে চলবে। তাই ভালো গল্প বেছে নিয়ে অভিনয় করছি। আর আজকাল বেশিরভাগ ভালো গল্পগুলোই নির্মাণ হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষায়। তাই বাধ্য হয়েই এসব নাটকে আমাকে বেশি দেখা যায়।

জাগোনিউজ : আপনার অভিনীত নাটকগুলো প্রায় হাস্য-রসাত্মক। রোমান্টিকতায় আপনাকে খুব বেশি দেখা যায় না। কেন?
চঞ্চল : প্রেমের নাটকের ঘ্যান ঘ্যানানি আমার ভালো লাগেনা। রোমান্টিক প্রেমিকের চাইতে গ্রাম্য চরিত্রে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পাই। আর মানুষ মনে বিনোদনের রসদ পাবে বলেই নাটক দেখে। এজন্য হাসির নাটকে সচারচার বেশি কাজ করি।

জাগোনিউজ : বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?
চঞ্চল : সবে তো আয়নাবাজি ছবির কাজ শেষ হলো। এবার ঈদের জন্য কিছু কাজ করবো। তারমধ্যে বর্তমানে বেশ কিছু নাটকে কাজ করছি। বৃন্দাবন দাসের রচনা ও সালাউদ্দীন লাভলুর পরিচালনায় ছয় খন্ডের তিনটা নাটকে কাজ করছি। এছাড়া এক ঘন্টার দুটি নাটকে কাজ করেছি এবং আরো কিছু নাটকে কাজের কথা চলছে। সবমিলিয়ে বেশ ব্যস্ত আছি।

জাগোনিউজ : নিজের অভিনীত নাটকগুলো কি দেখা হয়?
চঞ্চল : এক ঘণ্টার নাটক ও বিশেষ দিবসের নাটকগুলো দেখি। ধারাবাহিক নাটকগুলো তেমন দেখা হয়ে ওঠে না। যখন প্রচারিত হয় তখন অন্য নাটকের শুটিং সেটে থাকি। আগে নিজের অভিনীত নাটকগুলোর সিডি সংগ্রহ করে রাখতাম। এখন সিডি মার্কেটে আগের মতো নেই। সবাই ইউটিউবে ও মোবাইল ফোনে নাটক দেখে।  

জাগোনিউজ : এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। গায়ক হিসেবেও আপনার খ্যাতি আছে। কিন্তু গানে নিয়মিত নন কেনো?
চঞ্চল : প্রায় সাত-আট বছর আগে ‘পালকী’ নামে আমার একটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিলো। অনেক সাড়া পেয়েছিলাম। তবে গান করি নিতান্ত শখের বসে! আমি মূলত একজন অভিনেতা। আবার যখন ইচ্ছে হবে, সময় ও সুযোগ মিলবে নিশ্চয় গান করব।

জাগোনিউজ : খ্যাতির বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন কোনো সময়?
চঞ্চল : ইদানীং এই জিনিসটা খুব ফেস করতে হচ্ছে। যেখানেই যাই সবাই ঘাড়ে হাত দিয়ে সেলফি তুলতে চায়। হা হা হা। আমিও তো একজন মানুষ! ক`জনের এমন আবদার সহ্য করা যায়? এ ব্যাপারে খুব ইতস্তত বোধ করি। কিন্তু কিছু করার নেই।

Chanchal Chowdhury
জাগোনিউজ : আপনিতো ঢাবি`র চারুকলার ছাত্র ছিলেন! ক্যাম্পাসের রঙিন দিনগুলোকে মিস করেন না?

চঞ্চল : খুব মিস করি। সেই চারুকলার ক্যাম্পাস, ছবির হাট, টিএসসিতে বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে গিটারের টুংটাং সুর তোলা, রং-তুলির রঙিন ক্যানভাস- সবমিলিয়ে যখনই ঐ দিনগুলোর কথা মনে পড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলি সোনালী অতীতে। ব্যস্তার জন্য ক্যাম্পাসে খুব বেশি যাওয়া হয়ে ওঠে না। তবে পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা কখনো মিস করি না।

জাগোনিউজ : অভিনয় ছাড়া আর কি কি ভালো লাগে?
চঞ্চল : ঘুম। যখনই সময় পাই ঘুমোতে চেষ্টা করি। এছাড়া ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। তবে ঘোরাঘুরি যা করি শুটিংয়ের অজুহাতে। ব্যপারটা কলা বেচতে গিয়ে রথ দেখার মত।

জাগোনিউজ : ব্যক্তিগত জীবনে চঞ্চল চৌধুরী কেমন?
চঞ্চল : এক্কেবারেই একজন সাধারণ হাসিখুশি মনের মানুষ। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার মধ্যে কোনো অহংকারও নেই। সাধারণ একটা জীবন কাটিয়ে যেতে চাই ভালোবেসে, ভালোবাসায়....

জাগোনিউজ : আপনার ছেলে শুদ্ধকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেন...
চঞ্চল : শুদ্ধ আমাকে অনুসরণ করে। বড় হয়ে সে যদি চায় তাহলে অভিনয় করবে আমার কোনো আপত্তি নেই। অন্য কিছু হতে চাইলেও আমার সমস্যা নেই। আমি ওর ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দেই সবসময়। ওকে নিয়ে একটাই স্বপ্ন; ও যেন মানুষ হয়।

Chanchal - Shuddho

এলএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।