নোয়াখালীর তিন যুবকের বাড়িতে শোকের মাতম
গত বৃহস্পতিবার ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়া উপকূলে ট্রলার ডুবির ঘটনায় অন্যদের সঙ্গে নিখোঁজ রয়েছেন নোয়াখালীর তিন যুবক। আর এ তিন যুবকের গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের মাঝে চলছে শোকের মাতম। কোনো সান্ত্বনা তাদের কান্না থামাতে পারছে না।
নিখোঁজরা হলেন সোনাইমুড়ী উপজেলার চাষীরহাট ইউনিয়নের কাবিলপুর গ্রামের মৃত রফিক উল্লাহর ছেলে ফখরুল ইসলাম মুন্না, আমিশাপাড়া ইউনিয়নের পদিপাড়া গ্রামের হাজী নুর ইসলামের ছেলে সালাউদ্দিন এবং সেনবাগ উপজেলার ছিলাদিগ্রামের গোলাম ছারোয়ারের ছেলে গোলাম মাওলা।
সোমবার বিকেলে ফকরুল ইসলাম মুন্নার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, গোটা বাড়িতে শুন-সান নীরবতা। পুরো বাড়িতে যেনো শোকের হাওয়া বইছে। গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে এগিয়ে আসেন সবাই। কিন্তু সবার চোখে-মুখে কারো ছেলে, কারো ভাই, কারো প্রতিবেশী হারানোর বেদনা।
কথা হয় ফকরুল ইসলাম মুন্নার ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম বাবুর সঙ্গে। সে জানায়, তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে মুন্না ছিলো দ্বিতীয়। পরিবারের সচ্ছ্বলতা আনতে চলতি বছরের ৪ এপ্রিল তার ভাই সেনবাগের ছিলাদী গ্রামের গোলাম মাওলার সঙ্গে লিবিয়া যায়। স্থাণীয় ব্র্যাক ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ ও জমি বিক্রয়সহ আরো অনেক টাকা হাওলাদ করা হয়। সেখানে যাওয়ার পর একটি দোকানে চাকরিও পায়। কিন্তু এ পর্যন্ত বাড়িতে একটি টাকাও দেয় নাই। ভাই আরো বেশি টাকা আয় করার জন্য দালালদের খপ্পড়ে পড়ে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
গত ১৪ আগস্ট দুপুরে মায়ের মোবাইল কল দিয়ে তিনি দোয়া চান এবং তাকে মাফ করে দেয়ার জন্য বলেন। একই সঙ্গে সবার কাছে ও দোয়া চান। মা বার বার জিজ্ঞাসা করেন কী জন্য দোয়া মাফ চায়। মায়ের বার বার জিজ্ঞাসার ফলে তিনি জানান, এখন তিনি সাগর পাড়ে আছেন। দালালের মাধ্যমে ইঞ্জিনচালিত নৌকা করে তিনি ইতালি যাবেন। কয়েকদিন সাগরপাড়ে থাকতে হবে।
মায়ের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো জানান, ভালোমন্দ যাইই হোক আপনারা জানতে পারবেন। এসময় তিনি লক্ষীপুরের কাদের নামে এক দালালের মোবাইল নম্বর দেন। এ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভিতে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে হতাহতের খবর শুনে স্পেনে থাকা আমার চাচাতো ভাই মামুনকে ফোন করে ভাইয়ার খোঁজ-খবর জানতে চাইলে দালালের নম্বরটা তাকে দিই। তিনি দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানায় উক্ত নৌকায় তার কোনো লোক ছিল না। পরে আবার যোগাযোগ করা হলে জানায়, তার আটজন লোক ছিল। এর মধ্যে চারজনের সঙ্গে কথা হলেও সেনবাগের গোলাম মাওলা ও মুন্নার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। তার ধারণা তারা দুইজনই নৌকা ডুবে নিখোঁজ হয়েছেন।
এ খবর জানার পর থেকেই তার মা ও বোনরা ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করছেন। অকালে ভাইয়ের এ দুঃসংবাদ ও এবং ভাইয়ের জন্য বিভিন্ন ঋণ কীভাবে পরিশোধ করবে এ চিন্তায় তাদের সকলের ঘুম-আহার সবই বন্ধ হয়ে গেছে।
কথা হয় মুন্নার মা জাহেদা খাতুনের সঙ্গে। সন্তানকে হারিয়ে তিনি অনেকটা বাকরুদ্ধ। বারবার বলছেন আমার মুন্না আছে। সে ফিরে আসবে।
সোনাইমুড়ী উপজেলার আরেক যুবক সালাউদ্দিন (২৫)। তার গ্রামের বাড়ি উপজেলার আমিশপাড়া ইউনিয়নের পদিপাড়া গ্রামে। হাজী বাড়ির মৃত নুর ইসলামের ছেলে। সালাউদ্দিন ২০০৭ সালে লিবিয়ায় যান। যাওয়ার পর একটি দোকানে চাকরি করতেন। বৃহস্পতিবার লিবিয়া থেকে নদী পথে ইতালি যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে সালাউদ্দিন নিখোঁজ হন। লিবিয়ায় থাকা তার আরো এক ভাই মহিউদ্দিন বাংলাদেশে পরিবারের সদস্যদের ফোন করে বিষয়টি জানানোর পর থেকে পরিবারের সদস্যদের কান্না-আহাজারিতে আকাশ-বাতাশ ভারী হয়ে উঠেছে।
লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ সালাউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগের ছিলাদী গ্রামের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। গোলাম ছারোয়ারের নতুন বাড়িতে বৃদ্ধ মা আনোয়ার বেগম (৬০) ও বাবা গোলাম ছারোয়ার পুত্রের ছবি হাতে নিয়ে কান্নাকাটি করছেন।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল গোলাম মাওলা লিবিয়ায় যান। ৯ ভাই বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। সবার সুখের কথা এবং পরিবারের আরো সচ্ছ্বলতার কথা চিন্তা করে সেও লিবিয়া থেকে নৌপথে ইতালি যাওয়ার জন্য দালালদের খপ্পড়ে পড়েন এবং আরো কয়েকজন সেও ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য নৌকা করে রওনা দেয়। কিন্তু পথিমধ্যে তার ডুবে যাওয়ার পর থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে সেসহ ২৪ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে তার এ খবরে বাড়িতে থাকার স্ত্রী ও দুই বছরের ছেলে সন্তান হৃদয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কীভাবে কাটবে তার কোনো উত্তর কেউই দিতে পারছেন না।
মিজানুর রহমান/বিএ