নবীপ্রেমের স্বর্ণময় ইতিহাসের দিশারী ছিলেন গাউছুল আজম
নবীপ্রেমের সোনালী ইতিহাসের পাতায় যারা স্মরণীয় তাদের মাঝে হযরত গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু আপন কর্মকীর্তির গুণে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। নিজেকে করেছেন খোদার রঙে রঙিন, নবীপ্রেমে বিলীন। সুন্নাতে রাসূলের অলংকারে রাঙানো ছিল যার আপাদমস্তক।
যা কিছু করেছেন নবীপ্রেমের আলোকে, যা কিছু ত্যাগ করেছেন তাও নবীপ্রেমের জন্য। তারই প্রতিদানে বাইয়াতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়ে খলিফায়ে রাসূল উপাধিতে ভূষিত, গাউছুল আজমের পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত। শেষ যুগে নবীপ্রেমের এমন মহিমা বিরল। যার তরিক্বত বিপন্ন মানবজাতির জন্য হেদায়তময় শান্তির আলোকধারা।
বুধবার (৩ এপ্রিল) বাদে এশা চট্টগ্রাম রাউজান কাগতিয়া আলীয়া গাউছুল আজম দরবার শরীফে অনুষ্ঠিত কাগতিয়া দরবারের প্রতিষ্ঠাতা খলিলুল্লাহ আওলাদে মোস্তফা খলিফায়ে রাসূল হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর স্মরণে ৬৬তম পবিত্র মি’রাজুন্নবী (দঃ) উদযাপন ও সালানা ওরছে হযরত গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর ঈছালে ছাওয়াব মাহফিলে এ মহামনীষীর একমাত্র খলিফা, কাগতিয়া আলীয়া গাউছুল আজম দরবার শরীফের মহান মোর্শেদ আওলাদে রাসূল (দঃ) হযরতুলহাজ্ব আল্লামা অধ্যক্ষ শায়খ ছৈয়্যদ মোর্শেদে আজম মাদ্দাজিল্লুহুল আলী ছাহেবের বক্তব্যে এ কথা বলেন।
এ সময় মসজিদের বিশাল মাঠসহ পুরো দরবার শরীফ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কোথাও তিলধারণের কোনো জায়গা ছিল না। বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘হযরত গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবীর সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ত্যাগ করেছেন আপন জীবনের সুখ, শান্তি ও স্বার্থ। মানবতার কল্যাণে নিঃস্বার্থ এ অবদান মহাকাল ধরে রইবে স্মরণীয়, বরণীয় এবং গ্রহণীয়। তিনি পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি করে গেছেন নবীকে পাবার, নবীর পথে চলার ঐতিহাসিক এক পথ, যে পথের পাথেয় দীদারে রাসূল।’
তিনি বলেন, ‘নবীকে বুকে ধারণ করে তিনি রওজা পাকে রয়েছেন, রওজা পাকের দিকে সারি-সারি অবনত বৃক্ষরাজি তারই সাক্ষ্য বহন করে। বর্তমানেও বৃক্ষগুলো রয়েছে অবনত। তিনি এমন এক নবীপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্ত যা জগদ্বাসীর দৃষ্টিতে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ।’ এ মহান অলৌকিক নিদর্শন দেখার এবং হযরত গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র তরিক্বতকে গবেষণা করার জন্য তিনি উদাত্ত আহ্বান জানান।
এদিন ফজরের নামাজের পর খতম শরীফ, মোরাকাবা, ঈছালে ছাওয়াব, রওজা শরীফ জিয়ারত, মিলাদ-কিয়াম ও মোনাজাতের পর খতমে কুরআন ও বুখারী শরীফের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ওরছের কর্মসূচি।
প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও কাগতিয়া দরবার থেকে পূর্বেই ঘোষণা হয়েছিল ওরছে কারোর কাছ থেকে গরু, মহিষ, ছাগল, টাকা-পয়সা, নজর-নেওয়াজ ইত্যাদি নেয়া হবে না, চলবে না শরীয়ত পরিপন্থী কোনো কার্যকলাপ, শুধু কোরআন-সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণে পালিত হবে এ মহামনীষীর সালানা ওরছ।
তাই কাগতিয়া দরবারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছিল কোরআন-সুন্নাহ্র আলোকে একটানা দিন-রাত ব্যাপী ইবাদত-বন্দেগী, খতমে কুরআন, খতমে বুখারী, মিলাদ-কিয়াম, জিকির-এলাহী, নির্দিষ্ট তরতীবে নবীর শানে দরুদপাঠসহ নানান কর্মসূচি।
আলোকসজ্জিত করা হয় রওজা পাক, মসজিদসহ পুরো দরবার শরীফ। সপ্তাহজুড়ে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন প্রবেশমুখসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় উত্তোলন করা হয়েছিল তোরণ এবং বিভিন্ন ভবন ও আইল্যান্ডগুলোতে শোভা পাচ্ছিল কুরআন-হাদিস ও গাউছুল আজমের বাণী সংবলিত ফেস্টুন ও ব্যানার।
এদিন ভোর থেকে টুপি ও তসবিহ হাতে পায়ে হেঁটে, কেউবা গাড়িযোগে দলেদলে কাগতিয়া দরবারে আসতে থাকে এ মহামনীষীর লাখো অনুসারী, ভক্ত, আলেম, হাফেজ, যুবক, এলাকাবাসী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ধর্মপরায়ণ মুসলমান। প্রথমে জিয়ারত করে কুরআন তিলাওয়াত ও তাহলিল আদায় করতে থাকেন হাফেজ ও সাধারণ মুসলমানরা আর আলেমগণ আদায় করতে থাকেন খতমে বুখারী।
ছোট শিশুরাও বসে নেই, তারাও দলবেঁধে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করতে থাকে। কোথাও নেই ওরছের নামে সেই চিরাচরিত গরু-মহিষের দৌড়াদোড়ি, রশিদমূলে টাকা উত্তোলন, ঢাক-ঢোল কিংবা বাদ্য-বাজনা। অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে সবার মুখেমুখে শুধু উচ্চারিত হচ্ছে সুমধুর সুরে কুরআন তিলাওয়াত, তাহলিল ও নিম্নস্বরে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ জিকির এবং নবী (দঃ)’র শানে দরুদ পাঠ। এ যেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, প্রশান্তিময় পরিবেশ। শুধু দেশের নয়, সপ্তাহজুড়ে বাংলাদেশে আসা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মধ্যপ্রাচ্য, সৌদি-আরব, আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কাগতিয়া দরবারের শতশত অনুসারী এতে অংশ নেয়। জোহরের পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে এ কার্যক্রম।
বিদেশে অবস্থানরত এ মনীষীর অনুসারীরাও বাদ পড়েননি, তারাও এদিন স্বস্ব স্থানে বসে আর মহিলারা নিজেদের ঘরে বসে কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকেন।
জোহরের পর রওজা শরীফ জিয়ারত শেষে শুরু হয় পবিত্র মি'রাজুন্নবী (দঃ) ও গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর জীবনী শীর্ষক আলোচনা। এ সময় অশ্রুসিক্ত চোখে বক্তারা যখন এ মনীষীর নানান স্মৃতি, নসিহত স্মৃতিচারণ করছিলেন তখন কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। অনেককেই অঝোরধারায় কাঁদতে দেখা যায়।
আলোচনায় অংশ নেন মুনিরীয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশ ওলামা পরিষদের সভাপতি হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম হানফী, সচিব হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মুফতি কাজী মুহাম্মদ আনোয়ারুল আলম ছিদ্দিকী, সহ-এশায়াত সম্পাদক হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মুহাম্মদ এমদাদুল হক মুনিরী, আল্লামা মুহাম্মদ সেকান্দর আলী, মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল হক প্রমুখ।
বাদে আছর ফয়জে কোরআন, বাদে মাগরিব তাওয়াজ্জুহর মাধ্যমে নূরে মুহাম্মাদী বিতরণ, মোরাকাবা ও তাবাররুক বিতরণের পর এশার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে হামদ, নাতে মোস্তফা ও জিকিরে গাউছুল আজম। পরিবেশন করেন মুনিরীয়া যুব তবলীগের কেন্দ্রীয় হামদ-নাত পরিষদের সদস্যরা।
পরের দিন ৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজ শেষে খতম শরীফ, মোরাকাবা, ঈছালে ছাওয়াব, মিলাদ, কিয়াম ও আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় সালানা ওরছে হযরত গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু। এ সময় উপস্থিত সকলের কান্না ও আমিন আমিন ধ্বনিতে চারিদিকে এক শোকের পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
মোনাজাতে মোর্শেদে আজম মাদ্দাজিল্লুহুল আলী দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহ্র সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং দরবারের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু ফুয়ুজাত কামনা করেন।
এমআরএম/জেআইএম