বেঁচে ফেরার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন সাইফুর
আগুন লেগেছে টের পাইনি। ভবনের ফায়ার অ্যালার্ম থাকলেও কেউ বাজায়নি। প্রায় ২০ মিনিট পর যখন ধোঁয়া দেখলাম ততক্ষণে সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছেন। বিদ্যুৎও চলে গেছে। বহুতল ভবনটি নিমিষে গ্রাস করে অন্ধকার। সবার মধ্যে বাঁচার আকুতি। আগুন লাগার সময় ১১তলায় আমাদের অফিসে ছিলাম ২২ জন। থাই গ্লাস ভেঙে ইন্টারনেটের অপটিকাল ফাইবার ক্যাবল ধরে ঝুলে পাশের ভবনে যখন লাফিয়ে পড়ি ততক্ষণে আমি জ্ঞানশূন্য। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার মুখে-মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে।
এভারেই বনানী এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আহত অবস্থায় বেঁচে যাওয়া স্ক্যান ওয়েল লজিস্টিক বিডির কর্মকর্তা সাইফুর রহমান নিজের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন।
গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) আগুন লাগার সময় অন্য সহকর্মীরদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন ওই ভবনে। ভবনটির লেভেল-১০ (১১তম তলা) স্ক্যান ওয়েল লজিস্টিক বিডির অফিস। ফ্রেড ফরওয়ার্ডিং প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ২৩ বছর ধরে জড়িত ম্যানেজার (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাডমিন) সাইফুর রহমান।
শনিবার দুপুরে তিনি জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘চাকরি জীবন শুরুই এ ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানটিতে। গত ২৩ বছরের পেশাগত জীবনে কখনো এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইনি।’
‘জানি না আমি কীভাবে বেঁচে গেলাম। আগুনে আমাদের ২২ সহকর্মীর মধ্যে ৫ জন আমিনা, পারভেজ পলি, শ্রীলঙ্কান নাগরিক নীরস ও আরিফ মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ৪ জন্যই ম্যানেজার। আমার আগে নীরস লাফিয়ে পড়েন। যদি বুঝতাম তিনি লাফ দিচ্ছেন তবে চেষ্টা করতাম তাকে নিবৃত করতে,’ যোগ করেন সাইফুর রহমান।
অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ায় সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কীভাবে বেঁচে গেছি তা একমাত্র আল্লাহ জানেন। ঝুলন্ত তার ধরে ঝুলে পড়েছি। পাশের ভবনের এসির কম্প্রেসারে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যাই। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমাকে পানি দেয়া হচ্ছে। এরপর গুলশানে প্রেসক্রিপশন পয়েন্টে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।’
তিনি বলেন, ‘আজ (শনিবার) সকাল থেকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। সফুরা টাওয়ারের নিচে স্থাপিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কথা বলেছি। তারা কেউ আমাদের অফিসে যেতে দিচ্ছে না। পরে গুলশান বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনার মোস্তাক সাহেব জানালেন বিকেল তিনটার পর ভবনে ঢুকতে দেয়া হবে। তাই অপেক্ষা করছি।’
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সাইফুর বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর এন্ডি অ্যান্ডারসন, কান্ট্রি ডিরেক্টর প্রিয়ান সিনমেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মিস্টার হ্যারি বাংলাদেশে আসছেন। তাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। এতো এতো অব্যবস্থাপনার ভিড়ে কোনটার সমাধান খুঁজব?’
সাইফুর রহমান বলেন, ‘নিহত সহকর্মীদের পরিবার এবং আহত সহকর্মীরা ফোন দিচ্ছেন। কাউকে কোনো জবাব দিতে পারছি না। আজকে একটা বড় দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দায় খুঁজছি। দোষারোপ করছি। সত্যিই তো কেউ দায় এড়াতে পারে না। কিন্তু আমরা যারা আহত হয়েছি, প্রিয় সহকর্মী যারা মারা গেলেন তাদের ক্ষতিটার দায় কে নেবে? কেউ নেয় না। এ রাষ্ট্রও নেয় না। অবশেষে ক্ষতটা বয়ে বেড়াতে হয় স্বজনদের।’
‘তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পায় না। কখনো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পেলেও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এ অব্যবস্থাপনার সংস্কৃতি আমাদের শেষ করে দিচ্ছে। এর শেষ কোথায় জানি না কেউই,’ আক্ষেপ প্রকাশ করেন সাইফুর রহমান।
রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারে বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বেলা পৌনে ১টায় আগুন লাগে। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে ২৫ জন নিহত ও ৭৩ জন আহত হন।
জেইউ/এনডিএস/জেআইএম