সহিংসতা-উগ্রবাদ মোকাবেলায় প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বলেছেন, সহিংসতা-উগ্রবাদ দূর করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন পরিবারভিত্তিক মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা।
এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক পরিবেশ ও সর্বশেষ রাষ্ট্রীয়ভাবে উগ্রবাদবিরোধী মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। উগ্রবাদ চিন্তাধারাকে প্রশ্রয় না দিলে কোনো দেশেই তথা বিশ্বের উগ্রবাদ শব্দটিই আর থাকবে না।
সোমবার (২৫ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’র সহযোগিতায় ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ‘তারুণ্য রুখবে সহিংস উগ্রবাদ’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।
নাগরিক সংলাপে আলোচকের বক্তব্যে সাইফুল আলম বলেন, লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো উগ্রবাদীদের লালন পালন করে। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশও উগ্রবাদের সূচনা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। আমাদের দেশের জনগণ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের বিষয়টি অপছন্দ বলেই এই উগ্রবাদকে দমন করা গেছে। ধর্মের বিষয়টি যদি রাষ্ট্রসমাজ গোত্রের বাইরে রাখতে পারি তাহলে এ ক্ষেত্রে আরও সফলতা আসবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সময়ে সহিংস উগ্রবাদের মত নিষ্ঠুর বাস্তবতা কোনো রাজনৈতিক মতবাদ বা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পরিসংখ্যান বলে, উগ্রবাদ সৃষ্টির কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। কেননা, একেক পরিস্থিতিতে একেকভাবে উগ্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। কোনো ছকেই এই উগ্রবাদকে সরলীকরণ করা যাবে না। পাশাপাশি ধর্মের কারণে এককেন্দ্রিক চেতনার ফলে সহিংসতারও সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এ দেশে হরকাতুল জিহাদের কারণে যে সহিংস কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তারা আফগান ফেরত যুদ্ধ বলে নিজেদের দাবি করেছিলেন। এরপর এসেছে জেএমবি। এসব উগ্রবাদ যে শুধুমাত্র ধর্মের কারণে সৃষ্টি হয়েছে তাও বলা যাবে না। প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতার অপব্যবহার এর পেছনে দায়ী হতে পারে- বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের ডিআইজি খন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, দায় এড়ানোর সংস্কৃতি বাঙালিদের নেই। এই বাঙালি সত্তাকে সব সময় জাগ্রত রাখতে হবে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনের সাদৃশ্য রয়েছে। সে অনুসারে এই অপরূপ প্রকৃতির দেশে বাঙালি সত্তাকে সমন্বিত করলেই আমাদের সংবিধান সার্থক হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সহিংস উগ্রবাদ মোকাবেলায় আমরা তৃপ্ত নই, তৃপ্ত হওয়ারর বিষয়ও নয়। সাধারণত বিভিন্ন জাতীয় দিবসের আগেই উগ্রবাদীদের অপকর্মগুলো ঘটে। তাই আমরা ঢাকা শহরে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের সামর্থ্যকে সম্পূর্ণরূপে প্রদর্শন অর্থ উগ্রবাদীদের মেসেজ দেয়া। আমাদের সামর্থ্যের জানান দিতেই সোয়াতসহ বিভিন্ন বাহিনীকে নামানো হয়েছে।
সংলাপে সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ ব্রাদার চন্দন বেনেডিক্ট গোমেজ বলেন, আমরা আলোকিত মানুষ হতে শিখাই জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করার মাধ্যমে। আমাদের মূলমন্ত্র একটি সুন্দর হৃদয় সৃষ্টি করার লক্ষ্যে। ধর্ম আমাদের শেখায় আরও ভালো মানুষ হতে।
বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয় বলেন, ধর্মটা রাজনীতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব কমে যাচ্ছে। এ কারণে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়েছে। আসলে এ উগ্রবাদ দমন করতে হলে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সচেষ্ট হতে হবে।
রামকৃষ্ণ মিশনের সহকারী সম্পাদক স্বামী সেবানন্দ বলেন, সব ধর্মই সত্য। এটা সবাই স্বীকার করে নিলে হানাহানি বন্ধ হবে। অর্থাৎ সব ধর্মের লোকদের সম্মান করতে হবে। উগ্রবাদ একটি রোগ মাত্র।
তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ড. মুহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, নিউজিল্যান্ডের ঘটনা প্রমাণ করেছে মুসলিমরা শান্তিপ্রিয়। তাছাড়া মনে রাখতে হবে নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ নাগরিক অধিকার ও মানুষের সম্মান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। আমি সৌদি আরবে গিয়েও এতোটা সম্মান পাইনি, এসব দেশে গিয়ে যতটা সম্মান পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে নৈতিকতা শেখার জন্য উপযুক্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। যে কারণে শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীদের আনন্দদায়ক পরিবেশ উপহার দিতে হবে, তাদের ভালো মানসিকতায় পরিবর্তিত করতে হবে। তাহলেই সহিংস উগ্রবাদ এড়িয়ে চলা সম্ভব।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণের সভাপতিত্বে নাগরিক সংলাপে ন্যাশনাল ডিবেট ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সম্প্রীতি প্রকল্পের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আইরিন বাশার রিফাত, ইসরাত পারভীন, মিরপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ শায়লা মনোয়ার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জেইউ/আরএস/এমএস