পরিবেশ ও পানি দূষণে দায়ী কৃষিখাত!
দেশের কৃষি জমিতে সেচসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত মোট পানির পরিমাণের শতকরা ৭৬ ভাগই ভূগর্ভ (আন্ডারগ্রাউন্ড) থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। অবশিষ্ট মাত্র ২৪ ভাগ পানি উপরিভাগ (সারফেস) থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলনের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে মিঠা পানির পরিমাণ কমছে। সমুদ্রের লোনা পানি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করছে।
এভাবে ভূগর্ভস্থল থেকে পানি উত্তোলন অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্ত হয়ে পড়বে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বিশ্ব পানি দিবসের প্রাক্কালে বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের (বিসিজেএফ) নেতাদের সেঙ্গে দেশের কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে আলোচনাকালে এ আশঙ্কার কথা তথ্য জানান।
তিনি বলেন, প্রধানত বোরো ধান চাষেই ভূগর্ভ থেকে বেশি পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমিয়ে উপরিভাগ থেকে পানির ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে বলে জানান তিনি।
কৃষি সচিব মো. নাসিরউল্লাহ বলেন, ‘১৯৬০-এর দশকে এ চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন দেশে বোরো ধান চাষ হতো না। তখন জমিতে শতকরা ২০ ভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার ও শতকরা ৮০ ভাগ সারফেস ওয়াটার ব্যবহৃত হতো। কিন্তু পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশকে বোরো আবাদ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি হওয়ায় ২০০৬ সাল পর্যন্ত চিত্র ঠিক উল্টে (শতকরা ৮০ ভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড ও ২০ ভাগ সারফেস ওয়াটার) যায়। গত এক দশকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের ( পানির পাইপ লাইন নির্মাণ, ডাবল লিফটিং) মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে শতকরা ৭৬ শতাংশে নেমেছে।’
কৃষি সচিব বলেন, ‘কৃষি জমিতে বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতি কমাতে এখন জমিতে পাখি বসার দাঁড় ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ কমছে। পরিবেশ বিপর্যয়রোধে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমানোরও প্রচেষ্টা চলছে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা মাটির নিচেই ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দেয়ার নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন।’ ফলে জমিতে আর আলাদাভাবে ইউরিয়া সার দিতে হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ছাড়াও এ সমাজের মানুষের অসচেতনতার কারণেও পানি দূষিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরুপ রাজধানী ঢাকার আশপাশে বুড়িগঙ্গাসহ চারটি নদীর পানি দূষণের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন নয়, মানুষই দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) এক গবেষণা জরিপ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার চারপাশের নদীর পানি প্রতিনিয়ত দূষণ করছে ১৪৮টি উৎসমুখ। এসব উৎসমুখ থেকে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যার পানিতে পড়ছে নানা ধরনের বিষাক্ত কেমিক্যাল, রেডিমিক্স, পয়ঃনিষ্কাশন, শিল্প বর্জ্য, বাজারের বর্জ্য ও ড্রেনের পানি। দুষণকারীদের তালিকায় রয়েছে সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, নামিদামি শিল্পকারখানা, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন ও বিভিন্ন ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
এদের অনেকেই সরাসরি পাইপ দিয়েই নদীতে ফেলছে এসব বর্জ্য। এতে একদিকে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, অপরদিকে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সামনে গ্রীষ্ম মৌসুম। এ সময় পানির চাহিদা বেড়ে যায়। বিভিন্ন এলাকায় দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানির সংকট। এমনকি নলকূপের পানিতেও কেমিক্যালের উপাদান পাওয়া যায়। এ সময় বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনীয়তা তীব্রতর হয়। নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করলে তা সহজেই পরিশোধন করা যায়।
জানা গেছে, নদী দূষণে যুক্ত উৎসমুখের তালিকা সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এতে দেখা গেছে, সোয়ারীঘাট, কামরাঙ্গীরচরসহ এসব এলাকায় ওয়াসার অন্তত ২৭টি উৎসমুখ রয়েছে। এসব উৎসমুখ দিয়ে নদীতে পানি ও গৃহস্থালি বর্জ্য পড়ছে।
কেরানীগঞ্জের নবাবচর এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের অন্তত সাতটি উৎসমুখ থেকে নদীতে বর্জ্য পড়ছে। মিরপুর, ঢাকা উদ্যান ও গাবতলী এলাকায় রেডিমিক্স, কাঁচাবাজার, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, গরুর হাট, গার্মেন্ট কারখানা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডও নদী দূষণ করছে।
এমইউ/এসআর/পিআর