জাসদ বিতর্ক বিএনপি-জামায়াতকেই সুবিধা দেবে
‘জাসদ বিতর্ক বিএনপি-জামায়াতকেই সুবিধা দেবে। জাসদের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতেও তাই বলা হয়েছে। পঁচাত্তরের আগে জাসদ ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিতে চলে যায়। ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। জাসদ সম্পূর্ণ বিরোধী অবস্থানে চলে গেল। কিন্তু আমরা বিরোধী দলে থাকলেও, তা করিনি। সম্পূর্ণ বিরোধিতা এবং দায়িত্ব নিয়ে বিরোধিতার মধ্যে তফাৎ আছে।’
বলছিলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সাবেক এই মন্ত্রী জাসদ বিতর্ক নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : জাসদ বিতর্ক তুঙ্গে। ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যার পথ জাসদ পরিষ্কার করেছিল’ বলে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এক নেতা সম্প্রতি মন্তব্য করলে এমন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এই বিতর্ক নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : এগুলো ইতিহাস নির্ভর আলোচনা। আগস্টে আওয়ামী লীগকে অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে। এ কারণে আগস্ট এলে আবেগ সংবরণ করা যায় না। আবেগে অনেক কথাই চলে আছে। আদর্শিক জায়গা থেকেই জাসদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ জোটবদ্ধ হয়েছে। জাসদের সাংসদরা সরকারে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জাগো নিউজ : ভূমিকার বিষয়টি যদি পরিষ্কার করতেন?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : আওয়ামী লীগ এবং জাসদ উভয়কেই বুঝতে হবে মহাজোটের সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রাদায়িকতা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান থেকে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত দেশ গড়ার জন্যই আমরা জাসদের সঙ্গে জোট করেছি।
জাগো নিউজ : এমন দেশ বঙ্গবন্ধুও করতে চেয়েছিলেন কিন্তু জাসদ তখন বিরোধিতা করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে। গত শতকের সত্তর দশকের অবস্থান আর আজকের রাজনীতি এক নয়। নদীর পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। আমরা ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট নিয়ে একত্রিত হয়েছি। জাসদের সব কাজ আওয়ামী লীগ সমর্থন করে, তা বলা যাবে না। ভালো, মন্দ নিয়ে জাসদ তার নিজস্ব অবস্থানে আছে। আওয়ামী লীগও তার নিজস্ব অবস্থানে রয়েছে।
এর বাইরে রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এখন জাসদের অতীত ভূমিকা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন, তারা নিজ দায়িত্বেই তুলছেন। তবে বক্তাদের বক্তব্যে কিছু সিরিয়াস বিষয় এসে গেছে, যার ব্যাখ্যা জাসদের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা উচিত।
জাগো নিউজ : এই সময়ে এমন বিতর্ক রাজনীতিকে কোনো দিকে নিয়ে যেতে পারে?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : জাসদ বিতর্ক বিএনপি-জামায়াতকেই সুবিধা দেবে। জাসদের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতেও তাই বলা হয়েছে।
জাগো নিউজ : কিন্তু ইতিহাসের এই বিতর্ক এড়িয়ে চলা যায়?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : এড়িয়ে চলা যায় না ঠিক, কিন্তু বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকার সম্পর্কে জাসদের যে মূল্যালন, তা দেখে বলতে হবে তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্য ঢালাওভাবে বামদের দায়ী করা হচ্ছে। এটিও ঠিক না। এটি আগস্টের ভাবাবেগ। আগস্ট চলে গেলে এই আবেগ অনেকটাই কমে যাবে।
জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং জাসদের ওই সময়ের রাজনীতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : আমি তখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি করতাম। ১৯৭২-এর সংসদে আমি একমাত্র বিরোধী দলের নেতা ছিলাম। আমি আটবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। কখনও ন্যাপ, কখনও একতা, কখনও গণতান্ত্রিক পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়েছি। কিন্তু আমারও একটি নিজস্ব পরিচয় আছে। এখন আওয়ামী লীগ করছি। ব্যক্তি স্বার্থের জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ করছি না।
আমরা যখন ন্যাপ করেছি তখন জাসদের সঙ্গে স্পষ্ট পার্থক্য ছিল। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আমাদের নীতি ছিল দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে বিরোধিতা করা। আমরা ভালোকে ভালো বলেছি, খারাপকে খারাপ বলেছি।
জাগো নিউজ : জাসদও তো সেই জায়গা থেকেই বিরোধিতা করেছে?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : না, জাসদ তা করেনি। পঁচাত্তরের আগে জাসদ ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিতে চলে যায়। ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। জাসদ সম্পূর্ণ বিরোধী অবস্থানে চলে গেল। কিন্তু আমরা তা করিনি। সম্পূর্ণ বিরোধিতা এবং দায়িত্ব নিয়ে বিরোধিতার মধ্যে তফাত আছে।
জাগো নিউজ : ’৭২ পরবর্তী রাজনীতিতে দায়িত্বহীন বিরোধিতার কথা তো জাসদ স্বীকার করে না?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : জাসদ নেতারা তো এখন কাফফারার কথা বলে। অতীত ভুলের খেসারত দিতেই মহাজোটে শামিল হয়েছে বলে জাসদ নেতারা অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বক্তব্য দিচ্ছে। জাসদ আগের অবস্থান থেকে সরে এসে কথা বলছে।
এরকম পরিবর্তনের রাজনীতি আওয়ামী লীগও করেছে। আওয়ামী লীগ তো মুসলীম থেকে বেরিয়ে এসেই রাজনীতি করেছে। আওয়ামী লীগের নীতি আর মুসলীম লীগের নীতির মধ্যে বেশ তফাৎ রয়েছে। আমরা বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলেই বিরোধিতা করেছি। জাসদ বিরোধিতা করেছে শেখ মুজিব বলে। এখন জাসদ বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলেই মূল্যায়ন করে।
পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক মানুষের চিন্তাধারা। আরেকটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির চিন্তাধারা। আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই একত্রে শামিল হয়েছি।
জাগো নিউজ : তাহলে এই বিতর্কের শেষ কোথায়?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : এই বিতর্ক এগুতে দেয়া ঠিক হবে না। এই বিতর্ক চলতে থাকলে তৃতীয় পক্ষ সুবিধা নেবে। তবে কিছু বিতর্কের নিরসন হওয়া দরকার।
জাগো নিউজ : যেমন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : প্রশ্ন উঠেছে সামরিক শাসন জারির জন্য মোশতাকের সঙ্গে কর্নেল তাহের দেখা করেছেন। এই বিষয়গুলো আলোচনায় আনা উচিত এবং জাতির সামনে স্পষ্ট করা উচিত। জাসদের অতীত তো আছেই। আমরা ছাত্র ইউনিয়ন করে ন্যাপ করেছি। কিন্তু জাসদ আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে দল গঠন করেছে। হঠকারিতার মধ্য দিয়েই জাসদের সৃষ্টি। জাসদের হঠকারিতায় আওয়ামী লীগ, জাসদ এবং পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের এই ভূমিকা ইতিহাসের কাছে ছেড়ে দিতে হবে।
জাগো নিউজ : শুধু ইতিহাসের কাছে ছেড়ে দিয়ে এগুনো যায়?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : কিছু বিষয় ইতিহাসের কাছেই ছেড়ে দিতে হয়। অতীতকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করে পথ চলা যায় না, রাষ্ট্র ঘুরে দাঁড়ায় না।
এএসএস/এসএইচএস/এআরএস/এমএস